নদীর বুকে অদ্ভুত জীবন, নৌকা থেকে লাফ দিলেই তালাক

‘জলেই জন্ম, জলেই মৃ’ত্যু, জলেই বসবাস; নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস’—এক স্লোগানেই বেদে সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়।শত শত বছর ধরে প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা রয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের। বেঁচে থাকা ছাড়া যেন আর কোনো চাহিদাই নেই তাদের। নদীর স্রোত কিংবা বহমান বাতাসের মতো তাদের জীবন।

দেশের অ’তিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী বেদে। একসময় শুধুই জলে বসবাস করলেও এখন ডাঙায়ও তাদের দেখা মিলে। বই-পুস্তকে এই সম্প্রদায়কে বেদে নামে উল্লেখ করলেও, দেশজুড়ে রয়েছে অনেক নাম। বাদিয়া, বাইদ্যা বা বইদ্যানী নামে ডা’কা হয় বিভিন্ন অঞ্চলে। তাদেরকে জলের জিপসিও বলা হয়।

কেউ সাপুড়ে, কেউ গ্রাম্য চিকিৎসক

মোরা এক ঘাটেতে রাঁধি বাড়ি, মোরা আরেক ঘাটে খাই,

মোদের সুখের সীমা নাই… আম’রা সাপ খেলা দেখাই।

সাপ মানুষের ভ’য়ের কারণ হলেও বেদেদের কাছে জীবনধারনের প্রধান অবলম্বন।

সাপের খেলা দেখিয়েই রুটি-রুজি চলে তাদের। এই বিষধর প্রা’ণী যাদের হাতে খেলনা হয়ে ওঠে—তাদের কাছে জীবনযাপন তো খুব সাধারণ ব্যাপার।

সাপ খেলা দেখানোর জন্য সাপুড়েরা সাধারণত গোখরা ও অজগরই বেশি পছন্দ করে।

সাপুড়েদের গোখরা পছন্দের কারণ গোখরা মা’থার ফণা খানিকটা মাটির উপরে শূন্যে তুলে মেলে ধরতে পারে, যাতে থাকে দৃষ্টিনন্দন নকশা। তবে গোখরা বাঁশির সুরে নয়, সাপুড়ের দুলতে মা’থা, হাঁটু ও কনুইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির করার লক্ষ্যেই দুলতে থাকে। তবে নির্বিষ সাপও রাখে তারা।

সাধারণ হিসাবে বেদে সম্প্রদায়ের পরিচয় সাপ খেলা দেখানো জনগোষ্ঠী হলেও, মূলত এরা গ্রাম্য চিকিৎসক। যারা বংশ পরম্পরায় গাছ-গাছড়া থেকে চিকিত্সা পদ্ধতির দাবিদার। বেদেদের মধ্যে যারা মূলত সাপ খেলা দেখায় তারা বাঁশিসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এবং নানা উপায়ে সাপের খেলা দেখায়। সাপ অবশ্য বায়ুবাহিত শব্দ-তরঙ্গ অনুভব করে না, ফলে এতে সাপের সাড়া দেয়ার প্রশ্ন আসে না। এটি ঐতিহ্যগতভাবে পারিবারিক পেশা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হয়। এতে আছে কঠোর গো’পনীয়তা।

নদীর বুকে সংসার যেমন

বেদে সম্প্রদায়ের সংসার, পরিবার ও সমাজ একেবারেই ভিন্ন। বেদে ছে’লেরা সাধারণত কাজ করে না। মে’য়েরা যখন রোজগারে বাইরে যায় তখন সংসার ও বাচ্চা সামলায় তারা। ছে’লেরাই পুরো ঘর গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখে। তবে বেদেনীরা তাদের স্বামীকে ভালোবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখে। স্বামীকে বশে রাখতে কখনো শরীরে মালিশ করে দেয় সাপের চর্বির তেল, কখনো আবার করে রাখে তাবিজ-কবজ।

বেদে সমাজে সাধারণত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌথ পরিবারের মতো প্রথাগুলো খুব একটা দেখা যায় না। বেদেনীরা স্বাধীনচেতা। বেদে যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছায় পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়েতে সম্মত হয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করা হয়। বর-কনেসহ উপস্থিত সবাই নাচ-গানের মাধ্যমে উৎসবে মেতে ওঠে।

বিয়ে ও তালাক স’ম্পর্কে লক্ষীপুরের শাহ আলম মানতা জানান, কর্মজীবন যা-ই হোক, জীবনের নানা ক্ষেত্রে এ সম্প্রদায়ের রয়েছে বৈচিত্রময় কিছু রীতি। মু’সলমান হলেও বিয়ের রীতি ডাঙ্গাবাসী থেকে একটু ভিন্ন। এক থেকে অন্য নৌকায় পছন্দের মে’য়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। এরপর হুজুরের সাহায্যে কলেমা পড়ানো হয়। তবে একসময় টাকা দিয়ে মে’য়ে কেনাবেচা হতো। ৪০-৫০ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত বানে বিয়ে করতে হয় ছে’লেদের।

কখনো বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটলেও কোনো মে’য়েই ভেঙে পড়ে না। তবে মান-অ’ভিমান যে একেবারেই থাকে না তা নয়। বেদে হলেও মানুষের মন বলে কথা! বিয়ে ভেঙে দেয়ার নিয়ম বেশ সহ’জ। দাম্পত্য কলহের কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিলে বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। তাদের বিয়ের কোনো নিবন্ধন হয় না।

বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে মে’য়েকে বানের টাকা (যৌতুক) ফেরত দিতে হয়। আর পুরোনো হলে সম্পত্তির অর্ধেক দিতে হবে। কারণটাও যু’ক্তিসঙ্গত। বেদে সমাজে নারী-পুরুষ উভ’য়ই সমানতা’লে খাটে উপার্জনের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে ছে’লেদের চেয়ে মে’য়েরাই এগিয়ে থাকে বেশি।

প্রকৃতির সঙ্গে ল’ড়াই

লক্ষীপুরের আবদুল, হাবিব, জব্বার মানতাসহ আরো কয়েকজন জানান, মানতারা জীবনের কোনো না কোনো সময় নদী ভাঙনের শিকার। উপকূলীয় বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসরত মানুষরাই সম্পদ হারিয়ে জীবন বাঁ’চাতে মানতা সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আর এভাবেই উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বছর জীবন সংগ্রামী নতুন মানতাদের সম্প্রসারণ ঘটছে। মানতায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর বহর নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ ধরতে ঘুরে বেড়ায়। অনেক সময় জনমানবহীন দ্বীপাঞ্চলে এরা ভিড় করে।

আ’মেনা খাতুন নামের এক বেদেনী জানান, নদীর উচু ঢেউ বা প্রাকৃতিক দূর্যোগে শক্ত হাতে নৌকা চালাতে পারি। জলের গতির সঙ্গে সখ্যতা জন্মগত অধিকার। নদীর বুকে ভাসমান জীবন খুব ক’ষ্টের। ঝড়-তুফানেও বসে থাকার অবস্থা নেই।

সভ্যতার ছোবল বড় নি’র্মম

সাপের মতো সভ্যতার ছোবল বড় নি’র্মম। বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ সাপের ছোবল সামলানোর কলাকৌশল রপ্ত করলেও সভ্যতার ছোবল থেকে বাঁচতে পারছে না। ফলে তারা আজ অস্তিত্ব সংকটে। শহরের পথে পথে সাপ হাতে নিয়ে বেদেনীদের ঘুরে ঘুরে টাকা তোলা আমাদের কাছে অ’ত্যাচার মনে হলেও তারা বেঁচে থাকার জন্যই সাপ খেলা দেখানো বাদ দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছে।

পিছুটানের বালাই নেই, বাধাহীন-নির্ভা’র জীবন। সে কারণেই সাধারণ গৃহী মানুষ সবসময় এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করেছে বেদে সম্প্রদায়ের প্রতি। বেদে নারীর তীব্র টানে বিবাগী হয়েছে কত শত পুরুষ। বাংলা সাহিত্যে সেইসব কাহিনী খুব বড় স্থান দখল করে রয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন সাপের গল্প নিয়ে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। ‘বেদের মে’য়ে জোছনা’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি।