কামাল হোসেন থেকে যেভাবে হলেন তাসনুভা আনান

কামাল হোসেন শিশির। জ’ন্ম বাগেরহাটের মোংলায়। ‘পুরুষের’ বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর জ’ন্ম হলেও না’রীর স্বভাব নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। এভাবে তাঁর তথাকথিত ‘মেয়েলি আচরণ’ যখন স্প’ষ্ট হতে শুরু করে, তখন থেকে তিনি সমাজ দ্বারা নি’পী’ড়িত হতে থাকেন।

মানসিকভাবে ইতস্ততবোধের শুরুটা মূলত তখন থেকেই। তবুও নানামুখী সামাজিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে জীবনের পথ পাড়ি দিতে থাকেন কামাল।

সমাজের কাছে ধা’ক্কা খেতে খেতে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করে বাগেরহাট ছাড়েন কামাল হোসেন। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন না’রায়ণগঞ্জের একটি কলেজে। ততদিনে তাঁর শা’রীরি’ক পরিবর্তন আরও স্প’ষ্ট হতে থাকে।

সে সময়টায় চূড়ান্তভাবে ‘বু;লিয়িং’ বা হে’নস্তার শি’কা’র হতে থাকেন। তখনই মূলত তিনি পুরুষ থেকে না’রীতে রূপান্তরের ইচ্ছাপোষণ করেন। তবে এভাবে ‘রূপান্তরে’ সমাজই তাঁকে বা’ধ্য করেছে, বললেন শিশির।

২০১৬ সালের শে’ষের দিকে শিশির কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসকের পরাম’র্শে পুরুষ থেকে রূপান্তরিত না’রী হয়ে ওঠেন। তারপর নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন তাসনুভা আনান শিশির।

শনিবার সকালে তাসনুভার স’ঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। শিশির গ’ণমাধ্যমে কথা বলতে পারবেন কি না, সে কথা জেনে নিতে বৈশাখী টেলিভিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মক’র্তাদের সঙ্গে পরাম’র্শ করতে বললেন। তারপর ক’র্তৃপক্ষের অ’নুমতিসাপেক্ষে তিনি কথা বলেন।

কথার শুরুতে তাসনুভা আনান শিশিরের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, কেন তিনি রূপান্তরিত না’রী হতে চেয়েছিলেন। জবাবে শিশির বলেন, “আমার ‘মেয়েলি স্বভাব’ সমাজ মেনে নিতে পারেনি। তাই আমাকে নিয়মিত ‘বু;লি;য়িং’-এর শি;কার হতে হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, রূপান্তরিত না’রী হতে সমাজ আমাকে বা’ধ্য করেছে—তাই এই সি;দ্ধান্ত নেওয়া।’

সমাজ কীভাবে বা’ধ্য করল—সে প্রশ্নের উত্তরে তাসনুভা আনান শিশির বলেন, ‘যখন গ্রামে অর্থাৎ পরিবারের স’ঙ্গে ছিলাম, তখন আমার শারীরিক অ’ঙ্গভ’ঙ্গির পরিবর্তন নিয়ে হেন’স্তার শি’কা’র হতে হয়েছে। এরপর যখন স্কুল-কলেজে গেছি, পড়ালেখা করেছি—সেখানেও আমার সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে সবচেয়ে বেশি বু;লি;য়িং-এর শি;কার হয়েছি।

সে কারণে আমার বন্ধু, সহপাঠী ও শিক্ষকদের স’ঙ্গে আমার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই বললেই চলে। অথচ, সেখানে আমার কোনো দো’’ষ ছিল না। এটা তো হ;রমো;নাল বা জ’ন্মগত ব্যাপার।’

রূপান্তরিত হওয়া প্রস’ঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাসনুভা আনান বলেন, ‘রূপান্তরিত না’রী হতে প্রথমে আমি বাংলাদেশে ট্রিটমেন্ট নিই। কিন্তু, তাতে আমার কিছু সাইড ইফেক্ট দেখা দেয়। পরে আমি কলকাতায় যাই কাউন্সেলিং-এর জন্য। তারপর সেখানকার চিকিৎসকদের পরাম’র্শে আমি পু’রুষ থেকে না’রীতে রূপান্তরিত হই।’

এখন পরিবারের স’ঙ্গে যোগাযোগ হয় কি না, এমন প্রশ্নে তাসনুভা আনান শিশির বলেন, ‘বাগেরহাট থেকে নারায়’ণগঞ্জে যাওয়ার পর চাচার বাসায় ছিলাম। তারপর থেকে পরিবারের স’ঙ্গে একটু একটু করে যো;গাযোগহী’নতা তৈরি হয়।

এখন আর তেমন একটা যোগাযোগ হয় না। বাড়িতেও যাওয়া হয় না। তবে, গতকাল (শুক্রবার) রাতে আমার ভাই আমাকে ফোন করেছিল অনেকদিন পর। সাড়ে তিন মিনিট কথা হয়। আমার চার বোন ও এক ভাই, যাঁরা সবাই বিবাহিত।

আর, আমি আ’সলে পূর্বের অবস্থায় থেকে মা-বাবার কাছে যেতে চাইনি। মানে অবস্থার পরিব’র্তন হলে এবং সুযোগ এলে যেতে চেয়েছিলাম। সামনে হয়তো সেই সুযোগ আসন্ন। বাকিটা সময় বলে দেবে।’

বৈশাখী টেলিভিশনে নিয়োগ পেয়েছেন, সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ করবেন, কেমন লাগছে এখন—এমন প্রশ্নে শিশির বলেন, ‘বৈশাখী টেলিভিশনের অশোকদা (বার্তাপ্রধান অশোক চৌধুরী) আমাকে ফোন করে বিষয়টি প্রথম জানান।

নিয়োগ পাওয়ার খবরটি শুনেই আমি কেঁ’’দেছি’লাম। এ অ’নুভূতি ভাষায় প্র’কাশ করার মতো নয়। আমি স’ম্মানিত বোধ করছি। না’রী দিবসের মতো একটি বিশেষ দিবসকে কেন্দ্র করে আমার মতো রূপান্তরিত না’রীকে নিয়োগ দেওয়া হল, এটা অতি আনন্দের।

এটি সমাজেও একটি পজিটিভ রোল প্লে করবে। যারা আমার মতো, তারাও অ’নুপ্রাণিত হবে। সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো উদ্যোগ এটি। এবং এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণই বৈশাখী টেলিভিশনের। সত্যিই বৈশাখী পরিবারের প্রতি আমি চির কৃতজ্ঞ।’

তাসনুভা সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। ২০০৬ সাল থেকে থিয়েটারের স’ঙ্গে যুক্ত। তখন থেকেই উচ্চারণের দক্ষতা অর্জন করেছেন দা’বি করে তাসনুভা আনান শিশির বলেন, ‘বৈশাখী টিভিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য আমাকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

অডিশন দিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি আমাকে যো’গ্য মনে করেছে, তারপর নিয়োগ দিয়েছে। আমি সামনের দিকে আরও এগিয়ে যেতে চাই। এবং সমাজে নানামুখী ভূমিকা রাখতে চাই। আমি যতটুকু জানি, আন্তর্জাতিক না’রী দিবসের দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৪টার দিকে আমাকে সংবাদপাঠ করতে হবে।’

এসব ব্যাপারে বৈশাখী টিভির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক টিপু আলম মিলন গ’ণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা জানি, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল দেশের মানুষের মু’ক্তি, সবার জন্য বাসযোগ্য ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে গর্ব করার মতো অনেক অর্জন থাকলেও বৈষম্যহী’ন ও সবার জন্য নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার কারণে সবচেয়ে বড় অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ট্রান্সজেন্ডাররা অন্যতম।’

টিপু আলম মিলন আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছর, স্বাধীনতার মাস মার্চে না’রী দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে আমাদের চ্যানেলের সংবাদে এবং নাটকে দুজন ট্রান্সজেন্ডার না’রীকে যুক্ত করেছি। দেশের মানুষ এই প্রথম কোনো পেশাদার সংবাদ বুলেটিনে খবর পাঠ করতে দেখবেন একজন ট্রান্সজেন্ডার না’রীকে, যা স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে আগে কখনও ঘ’টেনি।

এই ট্রান্সজেন্ডার না’রীর নাম তাসনুভা আনান শিশির। আসছে ৮ মার্চ (সোমবার) আন্তর্জাতিক না’রী দিবসে শিশির

বৈশাখী টেলিভিশনে তাঁর প্রথম সংবাদ বুলেটিন উপস্থাপন করবেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে এক নজিরবিহীন দৃ’ষ্টান্ত স্থাপনে বৈশাখী টেলিভিশনের উদ্যোগের সহযাত্রী হবেন তিনি।

একইভাবে আমরা আমাদের বিনোদন বিভাগের নিয়মিত নাটকের মূল চরিত্রগুলোর একটিতে যুক্ত করেছি আরেকজন ট্রান্সজেন্ডার না’রীকে। তাঁর নাম নুসরাত মৌ। তাঁকে ৮ মার্চ রাতে দেখা যাবে বৈশাখীর পর্দায়।’ তথ্য সূত্রঃ এনটিভি অনলাইন।