প্রশান্ত কুমার হালদার। পি কে হালদার নামেই পরিচিত সর্বত্র। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। দেশে অর্থ কে’লেঙ্কারির সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। লিজিং
কোম্পানির নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে কানাডায় পা’লিয়ে যান তিনি। বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা পা’চার করে কানাডার টরন্টোতে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। সেখানে তিনি পা’চার করা অর্থে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। ওই দেশ থেকে তিনি মাঝে মধ্যে দুবাই ও ভারতে আসেন।
এখন তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। দু’র্নীতি দ’মন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গো’য়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুসহ সিন্ডিকে’টের সহায়তায়
কয়েকটি লিজিং কোম্পানির এ টাকা সরিয়ে পি কে হালদার দেশ থেকে পা’লিয়ে যান। একটি সূত্র জানিয়েছে, কানাডার টরন্টোতে তিনি মার্কেটও গড়ে তুলেছেন।
জানা গেছে, পি কে হালদার ও তার ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়। কানাডা স’রকারের অনলাইনে দেয়া তথ্য মতে, কানাডায় পি অ্যান্ড এল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে। যার পরিচালক পি কে
হালদার, তার ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কোম্পানিটির কার্যালয় ও বাসা কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটিতে। গুগল ম্যাপ ও টরন্টোর স্থানীয় প্রবাসীদের সহযোগিতায় বাড়িটির খোঁজ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, কানাডায় কয়েক বাংলাদেশি মিলে যৌথভাবে আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান রুনা করপোরেশনে বিনিয়োগ করেন পিকে হালদার। রুনা করপোরেশনের নিবন্ধন তথ্য মতে, ২০১৪ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৫শে
এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রে’সিডেন্ট ছিলেন তিনি। টরন্টোর তার নিজস্ব কোম্পানি পি অ্যান্ড এল হাল হোল্ডিং ইনক এবং যৌথ অংশীদারের প্রতিষ্ঠান রুনা করপোরেশনে প্রশান্ত বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেন। রুনা করপোরেশন
কানাডায় বড় বড় আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের জন্য পরিচিত। তাদের নির্মিত বিপুলসংখ্যক স্থাপনা রয়েছে কানাডার বিভিন্ন শহরে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় কানাডা প্রবাসীরা। কানাডার একজন প্রবাসী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এখানে পি কে হালদারের প্রভাব রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন কমিউনিটিতে সাহায্য সহযোগিতা করেন। তবে এ কয়েকদিন তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না বলে তিনি জানান।
লু’ট করা প্রতিষ্ঠান ধুঁকছে অর্থভাবে: একটি কম্পিউটার ব্যবহার করে কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে পিকে হালদারের সিন্ডিকেট পিপলস লিজিং থেকে লু’ট করে ৩ হাজার কোটি টাকা। রিলায়েন্স ও এএএস ফাইন্যান্স থেকে ৪ হাজার ৭০০ কোটি এবং
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। লু’ট করা টাকা সিঙ্গাপুর, ভারত ও কানাডায় পা’চার করেছেন। অথচ তার প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকগুরা টাকার জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন নানান জায়গায়। কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না ভু’ক্তভোগীরা। লু’ট করা প্রতিষ্ঠানগুলো ধুঁকছে অর্থের অভাবে। অনেকটা বন্ধই হয়ে গেছে পিপলস লিজিং-এর মতো বড় আর্থিক
প্রতিষ্ঠান। অথচ গ্রাহকের টাকা পরিশোধ না করেই, গত বছরের ১৪ই জুলাই কার্যক্রম স্থগিত করে পিপলস লিজিং। কেবল পিপলস ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নয়, টাকা লু’ট করে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পথে বসিয়ে পা’লিয়েছেন তিনি।
রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের এএমডি তাহের আহমেদ বলেন, যে পরিমাণ টাকা ডিমান্ড ছিল সেখান থেকে ১০/২০ ভাগ টাকা পরিশোধ করতে পেরেছি। বুঝেনই তো কেমন ক্রাইসিস যাচ্ছে। এই ক্রাইসিস থেকে ওঠতে আমরা চেষ্টা করছি। আমরা শতভাগ টাকা পরিশোধের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। এদিকে, শুধু ব্যাংকের টাকা লু’টপাটই নয় অভিনব
কায়দায় স’রকারি সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিয়েছেন তিনি। ভূমি অফিসের অ’সাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে জাল দলিলে রেজিস্ট্রেশন করে নেয়া হয় সাড়ে চার একরেরও বেশি জমি। ১২০ কোটি টাকা মূল্যের এ জমি দ’খলে সহযোগীর
ভূমিকায় ছিল স্থানীয় কয়েকজন দ’খলবাজ। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ এলাকায় তিনি এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। রূপগঞ্জের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই সাওঘাট ঈদগাহ ময়দান। পাশেই মসজিদ মাদ্রাসা ও কবরস্থান। এর সঙ্গেই মহাসড়ক বরাবর লম্বালম্বি বিশাল এলাকাটি স’রকারি খাস জমি জানতো এলাকাবাসী। যার লিজ বরাদ্দ ছিল মসজিদের
নামে। র্যা’বের অনুসন্ধানেও স’রকারি সম্পত্তি আ’ত্মসাতের প্রমাণ মেলে। হঠাৎই আধুরিয়া মৌজার স’রকারি ‘ক’ তফসিলভুক্ত ৪ একর ৬৭ শতাংশ জমির মালিক হিসেবে উঠে আসে আলোচিত পি কে হালদারের নাম। দুদক কর্মকর্তাদের
সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিজিং প্রতিষ্ঠানগুলো জামানতবিহীন, কাগুজে জামানত ও নামমাত্র স্থাবর জামানতের বিপরীতে এসব ঋ’ণ বিতরণ করায় তা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
পিকে হালদার কবে ফিরবেন কেউ জানে না: গত ২৫শে অক্টোবর দেশে ফেরার কথা থাকলেও অ’সুস্থতার অজুহাতে তিনি দেশে ফিরেননি। তবে তিনি কবে ফিরবেন এই খবর কারো জানা নেই। এই বি’ষয়ে পি কে হালদারের আইনজীবী
মাহফুজুর রহমান লিমন বলেন, আমিও জানি না, তিনি কবে দেশে ফিরবেন। তিনি কোথায় আছেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, শেষ বার যখন দেশে আসার কথা ছিল, তখন তিনি দুবাই অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বাংলাদেশের টিকিট কে’টেছিলেন। এর বাইরে আমি কিছু জানি না। আমার সঙ্গে তার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। আমি লিজিং
কোম্পানিটির আইনজীবী। তিনি দেশে ফিরলে তাদেরকে তখন জানানো হবে। পরে আমাকে জানানো হলে, আমি কোর্টকে জানাবো। এদিকে তার প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে একজন বলেন, তিনি কোথায় থাকেন সেটা আমরাও জানি না।
আমরা চাইলেও যোগাযোগ করতে পারি না। তার ইচ্ছে হলে তিনি যোগাযোগ করেন। কবে দেশে আসবেন সেটাও আমরা
জানি না। যদিও এর আগে অর্থপা’চারের মা’মলার মুখে নিরাপত্তা চেয়ে আ’দালতের হেফাজতে দেশে ফেরার ইচ্ছা পোষণ করলেও এখন তিনি আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন,
আইএলএফএসএলের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন জানিয়েছেন, পি কে হালদার আসবেন না। দুদক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে একটি মেইল করেছেন আইনজীবী মিলন। ই-মেইলে তিনি জানিয়েছেন, পি কে হালদার না কি কোভিড-১৯ এ আ’ক্রান্ত হয়েছেন। তবে আ’দালতের আদেশের পর দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত জানিয়ে আ’দালতকে তার
চিঠি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, চিঠির ভাষা আ’দালত অবমাননাকর। তার এমন আচরণ আ’দালত অবমানার শামিল। তিনি বলেন, পি কে হালদার বলেছেন তিনি তার সুবিধামতো সময়ে আসবেন। আবার দাবি করেছেন তিনি আ’দালতের আদেশ পাননি। তিনি তো একজন প’লাতক
আ’সামি। তার তো এতকিছু পাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি তো এখন তার ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আমাদের
করা মা’মলাটা যখনই আ’দালতে উঠবে তখন আ’দালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, সে ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে আসে নাই এবং কোর্টের অর্ডারটা ইচ্ছাকৃতভাবে ডিনাই করেছে। আমরা আ’দালতকে অনুরোধ করবো যেনো তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রে’প্তার করে দেশে নিয়ে আসা হয়। জানা গেছে, এর আগে দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান শেষে তিনি দেশে ফিরতে চান
এবং এজন্য তার নিরাপত্তা চেয়ে হাইকোর্টে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একটি আবেদন জানায়। আবেদনে বলা হয়, পি কে
হালদার দেশে ফিরতে চান। এজন্য তিনি নিরাপত্তা চান। বিনিয়োগকারীদের অর্থ পরিশোধ করতেই তার এ উদ্যোগ বলে আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এদিকে তিনি দেশে ফেরামাত্র তাকে গ্রে’প্তারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
পা’চারকৃত অর্থ ফেরত আনা জটিল প্রক্রিয়া: সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স আইন ২০১২ অনুযায়ী, কানাডাসহ পৃথিবীর ১৩২টি দেশ থেকে পা’চার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়। দুদকের আইনজীবী গণমাধ্যমে বলছেন, পি
কে হালদারের টাকাও ফেরত আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। আর আ’দালতে আবেদন করা হবে যাতে তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, পা’চারকৃত টাকা ফেরত আনা খুবই ক’ষ্টকর। এবং দেশে পা’চারকৃত টাকা ফেরত আনার নজির নাই বললেই চলে। শুধু কোকোর টাকা দেশে
ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এটা শুধু একটি উদাহরণ। বলবো না একেবারেই আনা যাবে না। অ্যাম্বাসিগুলোকে ব্যবহার করে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পা’চারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন প্রক্রিয়া।
অর্থপা’চারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বি’রুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অ’ভিযোগ প্রয়োজন হয়। অ’ভিযুক্ত ব্যক্তির বি’রুদ্ধে দেশের আ’দালতে রাষ্ট্রপক্ষকে মা’মলা করতে হবে। স্থানীয় আ’দালতে পা’চার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আ’দালতের এ রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থপা’চার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি
জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না তা নিয়ে ওই দেশের আ’দালতে মা’মলা করবে। সংশ্লিষ্ট দেশে পা’চার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা
রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করবে। পা’চারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আ’দালত থেকে পা’চারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বি’ষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরেই কেবল পা’চার হওয়া অর্থ ফেরত
আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই প্রক্রিয়ায় টাকা ফেরত আনতে ১০/২০ বছরও লেগে যেতে পারে। আরেকদিকে মা’মলা করা ছাড়াও পা’চার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অ’পরাধ দ’মন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। যদিও বাংলাদেশ এই গ্রুপের সদস্য। সবমিলিয়ে পি কে হালদারের অর্থ দেশ ফিরিয়ে আনার পথটি মোটেও সহজ না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।