করোনায় এলোমেলো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম

করোনাভাইরাস সংক্রমণ অন্য সবকিছুর মতো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম এলোমেলো করে দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের বিতরণ ও আদায়ের যে স্বাভাবিক শৃঙ্খলা ছিল, তা মারাত্বকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে করোনার মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উদ্যোগ চালু হওয়ায় ক্ষুদ্র ঋণের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। করোনাভাইরাসের কারণে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে অনেকেই নগদ টাকার সংকটে পড়ে ঋণ নিতে চাইছেন। নিম্ন আয়ের মানুষ, কৃষক, ছোট ছোট ব্যবসায়ী ঋণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের কাছে যাচ্ছেন। আবার পুরোনো গ্রাহকরাও নতুন ঋণের জন্য আসছেন। তবে আদায় কমে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান নীতিগতভাবে ঋণ বিতরণ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র ঋণের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রায় ৮০০ প্রতিষ্ঠান বছরে অন্তত ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করছে বিভিন্ন খাতে। প্রান্তিক পর্যায়ের সাড়ে তিন কোটি মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র চাষি, দিনমজুর, ছোট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা এর সুবিধাভোগী।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ ছিল। তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গত মাসের মাঝামাঝি থেকে থেকে সীমিতভাবে নতুন ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। এদিকে যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা বা বিভিন্ন উদ্যোগে যুক্ত, তাদের অনেকেই করোনার প্রভাবে ঋণ ফেরত দিতে পারছেন না। গত তিন মাসে ক্ষুদ্র ঋণের গ্রাহকদের অনেকেরই পুঁজিতে টান পড়েছে। এমনকি অনেক গ্রাহক তাদের সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন। এতে করে অনেকেই চলতি ঋণ পরিশোধের আগেই নতুন ঋণ চাইছেন। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্তদের এনজিওর মাধ্যমে ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে তিন হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন তারা। একই উদ্দেশ্যে পিকেএসএফের ৫০০ কোটি টাকাও দ্রুত বিতরণের সুপারিশ এসেছে। তারা বলেছেন, ক্ষুদ্র ঋণের তহবিলের বড় উৎস হলো ব্যাংক ঋণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তারা সংশয়ে আছেন।
দেশের ক্ষুদ্র ঋণের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের গ্রাহকদের অনেকে সঞ্চয় তুলে নিয়েছেন। এপ্রিল থেকে দেশের সবচেয়ে বড় এই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা গ্রাহকদের সঞ্চয় ফেরত দেওয়া শুরু করে। জুন পর্যন্ত ছয় লাখ ৪৫ হাজার গ্রাহককে ২৪৯ কোটি টাকা সঞ্চয় ফেরত দিয়েছে। আবার অনেকে নতুন ঋণের জন্য তাদের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। গত ১০ মে থেকে ঋণ কার্যক্রম শুরু করেছে সংস্থাটি। জুন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি গ্রাহককে তারা এক হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ১ জুলাই থেকে ব্র্যাকের কর্মীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের ক্ষুদ্র ঋণ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক সামেরান আবেদ সমকালকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় তাদের গ্রাহকদের অনেকেই মূলধন সংকটে পড়েছেন। এসব গ্রাহকের প্রয়োজন মেটানো ও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ব্র্যাক ঋণ বিতরণ অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, চলতি বছরে ব্র্যাক ৪৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নেয়। প্রথম তিন মাস কার্যক্রম ঠিক থাকলেও পরের তিন মাস কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ ছিল। বর্তমানে সীমিত পরিসরে কিছু গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এখন বাকি সময় কী করা যাবে, তা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। এই সংকটকালীন সময়ে অর্থনীতি সচল রাখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমআরএ তথা সরকারকেও নীতি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন গত এপ্রিল থেকে ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটি এ মাসের ১৫ তারিখ থেকে নতুন ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে এসএমই খাতে এই প্রতিষ্ঠানটি যে ঋণ বিতরণ করে তা কমিয়ে আনবে। বিশেষত তুলনামূলক বড় ঋণ তারা কমাবে। ২ে০২০-২১ অর্থবছরে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ কমানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আজাদুল কবির আরজু। তিনি বলেন, বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। ফলে কুটির শিল্প, ছোট ব্যবসায় বিনিয়োগ কমাতে হচ্ছে। তবে কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ছোট ঋণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র মে পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। জুনের মাঝামাঝি থেকে কৃষি ও এসএমই খাতে নতুন ঋণ বিতরণ শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. সালেহ বিন সামস বলেন, অনেকেই নতুন ঋণ চাইছেন। গ্রাহকরা বলছেন, কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু ঋণ আদায় হচ্ছে কম। ফলে নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও কমে গেছে।
ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান উদ্দীপন গত মাসে ৫৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। স্বাভাবিক সময়ে যা ১৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (ফিল্ড অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট) মো. সগীর হোসেন সমকালকে বলেন, তাদের পাঁচ লাখ ১৫ হাজার গ্রাহক। ঋণের চাহিদা এখন বেড়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় সবাইকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে না। যারা ঋণ নিয়ে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তাদেরই দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান ঘাসফুলের নির্বাহী পরিচালক আফতাবুর রহমান জাফরি বলেন, ঋণের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু কিস্তি আদায় না হওয়ায় নতুন ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তহবিল নেই। গত জুন মাসে কয়েকশ’ ব্যক্তি তাদের কাছে নতুন ঋণ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কিশোরগঞ্জের অর্গানাইজেশন ফর রুরাল অ্যাডভান্সমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ফকির মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ঋণ আদায় হচ্ছে না। গত মাসে যা আদায় হওয়ার কথা ছিল তার অর্ধেক আদায় হয়েছে। আবার নতুন ঋণের চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় সবাইকে ঋণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমআরএর নির্বাহী চেয়ারম্যান অমলেন্দু মুখার্জি বলেন, ঋণ চাহিদা বেড়েছে। এজন্য এমআরএর পক্ষ থেকে নতুন ঋণ বিতরণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকার তহবিল দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব তহবিল রয়েছে। এক কথায় গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড উজ্জীবিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
গত ২২ মার্চ এমআরএ এক সার্কুলারে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয় যে, করোনাভাইরাসের কারণে ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ কারণে কোনো গ্রাহকের ঋণ ৩০ জুন পর্যন্ত খেলাপি দেখানো যাবে না। এরপর ২৫ মার্চ অন্য এক সার্কুলারে ওই সার্কুলারকে আরও স্পষ্ট করে জানানো হয়, কোনো গ্রাহককে ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাধ্য করা যাবে না। তবে কোনো গ্রাহক স্বেচ্ছায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে ইচ্ছুক হলে সেক্ষেত্রে কিস্তি নেওয়ায় বাধা নেই। পাশাপাশি নতুন ঋণ বিতরণে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বলে ওই সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়। এরপর গত ২৩ জুন অন্য এক সার্কুলারে গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে বাধ্য না করার নির্দেশনা ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে এমআরএ।