দ্য গার্ডেন অব লাভ: ভালবাসা থেকে শিল্পযুগ

বয়স তখন কতইবা হবে। হাইস্কুলে পড়ি। দৌড় বলতে আজাদ প্রোডাক্টস থেকে হলমার্ক । কেনাকাটা মানে ডিসকাউন্টে কিছু গ্রেটিং কার্ড আর শো পিস। এদিকে ঋত্ত্বিক রোশনের মুভি দেখে ইরিক স্যাগালের “লাভ স্টোরি” চিনেছি। বইয়ের আবার “পাইরেট কপি” কি তা বোঝার মতো বুদ্ধি হয়নি তখনও। হলমার্কের মতো বড় দোকানে পাইরেট কপি পাওয়া যাবে, তাও এত্ত দামে বিক্রি হবে এসব কথা তো মাথাতেও আসে না। প্রতিদিন টিফিনের টাকা জমাই আর টিউশন ক্লাসে যাবার সময় হা করে গ্লাসের ভেতর দিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। একদিন টিফিনের জমানো টাকা , বাবা মার পকেট থেকে মারা টাকা আর টুকটাক কিছু খুচরো টাকা সব জমিয়ে বইটা কিনেই ফেললাম। একে তো ক্লাসে ব্যাক ব্রেঞ্চার ৷ ইংরেজির আগা গোরা বুঝি না তো কিছুই। ডিকশনারি নিয়ে বসে পড়লাম। সেই থেকে ভ্যালেন্টাইন ডে – ও চিনলাম। মানে যাই করো, যেখানেই করো, যার সাথেই করো…..ভালবেসে করো। হোক সে কাজ আর হোক সে মানুষ। ভালবাসা দূরে থাক কিংবা দোরগোড়ায়। বেঁচে থাকলে ভাল তোমাকে বাসতেই হবে। এতো আগডুম বাগডুম বকার উদ্দেশ্য হল- ভালবাসার কথাই বলতে চাইছি । শিল্পী পিটার পল রুবেন্স (১৫৭৭-১৬৪০সাল) ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হেলেন ফরমেন্টের ভালবাসার কথা।

১৬০০ সাল। তেইশ বছরের যুবক ফ্লেমিস পেইন্টার রুবেন্স। কারাভাজ্জিও এবং কারাক্কির অনুসারী রুবেন্স। কারাভাজ্জিওর মত মিথলজি প্রিয় এবং কারাক্কির ন্যায় প্রকৃতিপ্রেমী হলেও ইতালিয়ান সমকালীন নতুন রীতিকে মুহূর্তে বুঝে ফেলেছিলেন তিনি। ফ্লোরেন্টাইন শিল্পীদের মতো সঙ্গাহীন সুন্দরের দেখা পেয়ে তিনি সুন্দরের নিজস্ব রূপ দিয়েছিলেন মিথলোজি এবং প্রকৃতির সহাবস্থানে।

১৬০৮ সালে তিনি আনট্রাপ গমন করেন। সেখানে তার বন্ধুত্ব হয় প্রথম ফিলিপ রুবেন্সের সাথে। ফিলিপের স্ত্রী মেরী দি ময় ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী ইসাবেলা ব্রান্ট্রর খালা। সেই সূত্র ধরেই ৩ অক্টোবর ১৬০৯ সালে বিয়ে হয় রুবেন্স এবং ইসাবেলার। তৎকালীন আনট্রাপের নামকরা ব্যবসায়ী ১ম ড্যানিয়েল ফরমেন্টের পুত্র ড্যানিয়েল ফরমেন্ট। রুবেন্সের চিত্রের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ড্যানিয়েল ।বন্ধুত্বতার সূত্র ধরে রুবেন্সের স্ত্রী ইসাবেলা ব্রান্টের বোনকে বিয়ে করেছিলেন ড্যানিয়েল।

১৬২৬ সালে ইসাবেলার মৃত্যুর পর হঠাৎ ভীষণ বিষণ্ণ সময় পার করছিলেন রুবেন্স। এই চার বছরে তাঁর আঁকা খুব অল্প সংখ্যক ছবির হদীস মিলেছে। অতঃপর চার বছর পর ১৬৩০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সী হেলেন ফরমেন্টের সাথে বিয়ে হয় রুবেন্সের। হেলেন ছিলেন রুবেন্সের পেইন্টিং- র ভক্ত । বন্ধু ড্যানয়েলের ৯ ভাই বোনের একজন হেলেন । বিয়ের সময় রুবেন্সের বয়স ছিল ৫২ বছর আর হেলেনের ২৬। কিন্তু এই অসম বয়সী মেয়েটিকেই যে তিনি এতোটা ভালবাসবেন এবং সেই ভালবাসাই বিখ্যাত কিছুর জন্ম দিবে তা হয় তো রুবেন্স নিজেও ভাবতে পারেননি।

১৬৩০ সালে দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকে রুবেন্সের অঙ্কিত বেশির ভাগ চিত্রের বিষয় বস্তু ছিল স্ত্রী হেলেন, নিজের সন্তান এবং ঘরগৃহস্থালী। তিনি নিজেও বলেছেন- ” At home, very contented “। এমনকি অনেক মিথলজিক্যাল চরিত্রও তিনি হেলেনের আদলে আঁকতেন। ১৬৩১- ১৬৩৩ সালের মাঝামাঝি কোন একসময়ে তিনি আঁকলেন এক বিস্ময়কর চিত্র – “দ্য গার্ডেন অব লাভ”। সূচনা লগ্নে যার নাম ছিল “দ্য গার্ডেন পার্টি”। এটি রুবেন্স তার আনট্রাপের বাড়ির সামনের বাগানে বসে এঁকেছিলেন। ১৬৬৬ সালে চিত্রটি স্প্যানিশ রাজার রয়্যাল প্যালেস অব মাদ্রিদ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে এটি মাদ্রিদের পার্ডো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।

এই চিত্রটি একটি আলোকোজ্জ্বল জীবনের সুখের প্রতীক। চিত্রে একই সাথে অবস্থান করছে প্রেমিক যুগল, কিউপিডস এবং জীবন্ত প্রায় ভেনাসের ভাস্কর্য। ধারণা করা হয় ছবির বাম দিকের পুরুষ ফিগারটি রুবেন্স নিজে এবং বেশ কয়েকজন নারীর মাঝে চেয়ারে বসা নারী ফিগারটি তার স্ত্রী হেলেন। আউটডোরে আঁকা মেরী কম্পানী রীতির চিত্র এটি। এরীতির মূল উদ্দেশ্য হল একইস্থানে অনেকজন মিলে একধরনের কম্পোজিশন তৈরি। তবে মেরী কম্পানী ঘরনার চিত্রগুলো যতোটা উগ্র ধরনের হয় তেমনটি এখানে দেখা যায় না। বরং অনেকটা ঐশ্বরিক অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন রুবেন্স। অন্যদিকে ব্যারক রীতির ঐশ্বর্যময় চাকচিক্য ও জমকালো ভাব সমকালীন দর্শককে ছবিতে উপস্থিত থাকার বিষয়কে কিঞ্চিৎ পরোক্ষ ভাবেই নির্দেশ দিচ্ছে। ৬.৫ফিট দ্ধ ৯.৪ফিট আকৃতির চিত্রটিতে উঠে এসেছে ১৭ শতকের ফ্যাশন সচেতন একদল বিত্তবান শ্রেনীর বাগানে বনভোজন করার গল্প।

মাল্টিলেয়ার এলিগরিক ও প্রতীকী চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে চিত্রের প্রতিটি অংশে। মিথোলজিক্যাল চরিত্র কিউপিডস ও ভেনাস এখানে রিয়েলিস্টিক বাগানে এলিগরিক চিন্তার প্রত্যক্ষ সমন্বয় ঘটিয়েছে। বিয়ে আর ভালবাসা বা বিয়ের পর ভালবাসার অলৌকিকতা ও লৌকিকতার মেলবন্ধন চিত্রটিকে করেছে আরো মোহনীয়। রুবেন্স তার আন্ট্রাপে অবস্থিত বাড়ির উঠোনের সবটা জায়গা কাজে লাগিয়েছেন ভালবাসার কিউপিডকে ছড়িয়ে দিয়ে। প্রাচীন হেলেনিস্টিক ভাস্কর্য অঙ্কনে রুবেন্স তখন সিদ্ধহস্ত। সেই দক্ষতার ছাপ পড়েছে তার অঙ্কিত ভেনাসের ভাস্কর্যটিতে। ভেনাসের স্তন বেয়ে তিন গ্রেসে বয়ে যাওয়া ঝর্ণা রুবেন্সের চিত্রাংকনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে প্রতীয়মান করেছে- কোমনীয় শরীর, উর্বর ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এবং অধিকতর কামনাময়ী সৌন্দর্য। তবে এই সবগুলো ফর্ম মূলত একটি বিষয়ের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছে; শরীর ও প্রকৃতির সৌন্দর্য। নগ্ন ভেনাসের ঠিক পেছনে রাখা ময়ূরের পেখমটি বিবাহের দেবতা জুনোর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কনটেম্পোরারি দর্শক শ্রেণীকে আকর্ষণ করার মতো কোন উপকরণই যেনো ভুল করেও বাদ দেননি শিল্পী।

দ্য গার্ডেন অব লাভ চিত্রটির মোটিফগুলো অনুপ্রাণিত হয়েছে রেনেসাঁ যুগের চিত্র ভাবনা থেকে । প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে শিল্পী অনুস্মরণ করেছেন মেনারিজম চিত্ররীতিকে। কিন্তু সমগ্র চিত্রের ডেকরেটেড নৈপুণ্যতা এবং স্থাপত্য নক্সার পরিপাটি চিন্তা আগে দেখা গেলেও এতোটা নিখুঁত ভাবনা ছিল অকল্পনীয়। যে বিষয়টি আমরা পরবর্তীতে ফ্রাঞ্চে আঠার শতকের রোকোকো শিল্পযুগে পাচ্ছি।

রোকোকোর জন্ম হয়েছিল পঞ্চদশ লুইসের সময় ভারসাইলস প্যালেসের অন্দরমহল সজ্জায়। ঠিক এই বিষয়টিই আমরা দেখেছি দ্য গার্ডেন অব লাভ- এ চিত্রায়িত স্থাপত্যশৈলীতে। তাছাড়া ব্যারক রীতির নাটকীয়তা ছাড়াও যুক্ত হয়েছিল ভালবাসা, পরিপাটি নক্সা, আভিজাত্য আর উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার তো আছেই। এসবই রোকোকো শিল্পযুগের উপজীব্য বিষয়। তবে ফ্রেঞ্চ একাডেমীর বদৌলতে রুবেনিস্ট রীতির নিয়মিত চর্চায় রুবেন্সের পৃষ্ঠপোষকতা তখনও জারি রেখেছে। সমকালীন যে সকল শিল্পী এই রীতিতে কাজ করতেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলে জ্য এন্টোনি ওয়াট্টেও। যিনি সরাসরি রুবেনিস্ট রীতির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তার চিত্রে। যদিও ১৬২২-১৬২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে রুবেন্স অঙ্কিত মেরী দি মেডিচি কুইন অব ফ্রান্স – চিত্রাটিতে রোকোকোর ইঙ্গিত অনেকাংশেই পাওয়া যায়। তবে দ্য গার্ডেন অব লাভ- ই রোকোকোর বৈশিষ্ট্যকে অধিকিতর ধারণ করেছে এটা জোর গলায় বলা যেতেই পারে ।

এই হল ভালবাসার কথা। ভালবাসা থাকলে সব হয়। তা সে জীবনের শুরুতে কিংবা বয়সের শেষ সময়ে। হেলেনের ভালবাসাই পেরেছিল রুবেন্সকে অনুপ্রাণিত করতে। একটি নতুন শিল্পযুগের জন্ম দিতে। ভালবাসা আলো ছড়াক।ভালবাসা কাল ছাড়াক। জিবরানের মতো বলাই যায়- “ভালবাসার জন্য ভালবাসাই যথেষ্ট। ” ভালবাসার জয় অনিবার্য, হক সে সম কিংবা অসম। আকুলতা কতটুকু গভীর থেকে গভীরতম হলে ভানুসিংহ তাই বৈষ্ণব পদাবলীর পটভূমিতে বলে গেছেন- ‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান”। এপার বা ওপার বলে যাই থাক না কেন ভালবাসার জন্যই তা বার বার ফিরে এসে জাতিস্বর নাম নেয়। ভালবাসাকে পুঁজি করে বাঁচি। আবার ভালবাসার কারণেই বিখ্যাত হতে চাই।