চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের মাত্র পাঁচ মাসে বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফেলেছে সরকার। গত ১ জুলাই থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার এ খাত থেকে ঋণ নিয়েছে ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।
মূলত রাজস্ব আদায়ে হতাশাজনক পরিস্থিতি এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা চলতে থাকলে অর্থবছর শেষে ঋণ নেয়ার পরিমাণ সোয়া লাখ কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে।
যদি তা-ই হয় তাহলে তা বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুলাই থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ৪২ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ শতাংশ। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পুরো সময়ে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়েছিল ২৬ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা।
আয় কমছে রাজস্ব খাতেও। জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে প্রায় ৪৭ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এই সময়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি সঞ্চয়পত্র ও বন্ডের মুনাফায় ১০ শতাংশ কর আরোপ করায় এই খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে এই খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমেছে। এ কারণে ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৫ হাজার ৫১২ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১৭ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় এ অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ১২ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমেছে। কিন্তু সরকারের ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। এই ব্যয় মেটাতে হলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। এ ছাড়া সরকারের আর কোনো আয়ের উৎস নেই।
সাধারণত ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত নিরুৎসাহী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য অর্থনীতিবিদরা বরাবরই ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
তবে ড. জাহিদ তা মনে করেন না। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগে থেকেই কম ছিল। ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মূল কারণ হলো ব্যাংকে তারল্য সংকট ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। তবে সরকারের ঋণ নেওয়ার কারণে আরেকটু চাপে পড়বে এই খাতের ঋণ বিতরণ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ডলার বিক্রি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৯৯ মিলিয়ন ডলার বিক্রি হয়েছে। ডলার বিক্রি করলে ব্যাংকে টাকা কমে। এ কারণেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ।
ঋণ কমিয়ে আনতে এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় কি জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন সরকারের প্রকল্প ব্যয় কমানোর কথা বলেন। তিনি বলেন, এডিপিতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অনেক ছোট ছোট প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। যেহেতু বড় প্রকল্পে বন্ধ করা যাবে না, তাই অপ্রয়োজনীয় ও প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোতে সংশোধনী এনে সেগুলোর আকার ছোট করতে হবে। এতে সরকারের ব্যয় কমবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে ১৮ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঋণ নিয়েছে সাত হাজার ৯৫০ কোটি টাকা এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ঋণ নিয়েছে ২৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।