একদিকে নতুন বোতলে পুরনো বিষ। আরেকদিকে মনোননয়ন বাণিজ্যের অভিশাপে ভোট যুদ্ধের শুরুতেই অভিশপ্ত বিএনপি ও তার ধানের শীষ। শেষ মুহূর্তে লন্ডন, মালয়েশিয়া ও ঢাকার তেজগাঁওয়ের নিভে যাওয়া বাতির আলোতে বসে থাকা সিন্ডিকেটের মনোনয়ন বাণিজ্য দেশের রাজনীতিকেই নয়, গোটা বিএনপিকেই ঝাঁকুনি দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন বাতিল হওয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে এবারও বিএনপি ছাড়তে পারেনি।
নতুন বোতলে ইতিহাসের পুরনো বিষ ভরে নিয়ে ভোট ময়দানে নামতে গিয়ে চমক সৃষ্টি দূরে থাক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিবিদ নিয়ে যে আলোচনার ঢেউ তুলেছিল সেটিও এখন বন্ধ্যা নদীর জলের মতো। একদম নিষ্প্রভ। জামায়াতকে আসন দিয়েছে ২২টি। অন্যদিকে ড. কামালসহ ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোকে আসন দিয়েছে ১৯টি!
ঐক্যফ্রন্টের মুখ আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনের মুখ জাতির সামনে ভাসলেও মনোনয়ন বাণিজ্যের ভিতর দিয়ে কর্তৃত্ববাদী চেহারায় উন্মোচিত হয়েছেন নির্বাসিত ও দণ্ডিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডনে তাকে ঘিরে থাকা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে। দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থাকা তার ছোট ভাই মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধেও রমরমা মনোনয়ন বাণিজ্যের সরব সমালোচনা।
এক সময়ে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের বিশ্বস্ত ও অনুগত একদল সহচর তেজগাঁওয়ের একটি অফিসে বসে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন— এমন অভিযোগ বাতাসে ছড়াচ্ছে। টানা ১২ বছর বিএনপি নেতা-কর্মীরা নির্যাতন-নিপীড়ন ও নির্বাসনের সাজা ভোগ করেছেন। ভবিষ্যৎ তাদের অন্ধকার। মামলার জালে তারা আটকা। পুলিশের তাড়া খেয়ে ভীতসন্ত্রস্ত।
স্বাভাবিক জীবনযাপন শান্তি ও স্বস্তি হারাম। অনেকের প্রত্যাশা ছিল এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জয়-পরাজয় যাই হোক বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু অসংখ্য মামলা অভিরাম হয়রানি ও কারাদহন ভোগ করেও জনপ্রিয় নেতাদের বদলে দলের মনোনয়ন বাণিজ্যের খোলা বাজার থেকে যেভাবে নব্যরা আচমকা মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন তাতে কারাগারের ভিতরে বাইরে থাকা মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। হতাশার চাদরে ঢাকা পড়েছে নেতা-কর্মীদের ত্যাগের ১২টি বছর।
মাঠের পুড়খাওয়া কর্মীরা বারুদের মতন জ্বলে উঠেছেন। বিএনপি নয়াপল্টন ও গুলশান কার্যালয়ে তালা দিয়েছে। স্লোগান তুলেছে। মনোনয়ন বাণিজ্য মানি না মানব না। দলের ক্লিন ইমেজের সৎ মহাসচিব নিরপরাধ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িতে হামলার মধ্য দিয়ে তাদের রাগ প্রশমিত করেছে। এই মনোনয়ন বাণিজ্য সিন্ডিকেটের আড়ালে একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ দু-চারজন একাধিক চিঠি দিয়ে ক্ষুদ্র বাণিজ্য সেরে নিয়েছেন।
১২ বছরের তিক্ত যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি যখন এভাবে মনোনয়ন বাণিজ্য করে দলের ত্যাগীদের ছুড়ে ফেলে দেয়, ইতিহাসের স্রোতধারার বিপরীতে জামায়াতকে ধানের শীষ বানিয়ে ফেলে তখন সবার প্রশ্ন জাগে এই বিএনপি ইতিহাস থেকে শিক্ষাটা নিয়েছে কোথায়? এই বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে দলের রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব কতটাই বা থাকবে?
জামায়াতের চেয়ে কম আসন পাওয়া ঐক্যফ্রন্ট নেতা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন সুমহান মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষায় যে সৎ রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক আদর্শিক শাসন ব্যবস্থার কথা বলছেন তাতে বিএনপির অভিশপ্তদের পাল্লা জামায়াতীদের নিয়ে কীভাবে করবেন সেই প্রশ্নও এখন তামাদি হয়ে যাচ্ছে। যে শোরগোল তুলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এসেছিল সেটি এখন সম্ভাবনার আলোর টানেল ছেড়ে সেই অন্ধকার পথেরই ইশারা দিচ্ছে। এই বিএনপি ও জামায়াত মাঝখানে ড. কামাল হোসেনের জন্য নেতৃত্ব গ্রহণের কারণে অভিশাপের ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বোঝা তিনি নামাবেন কী করে?
সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে নকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হিরো হয়েছিলেন। কচুয়ার মানুষ তার দুঃসময়ে নামাজ পড়েছে রোজা রেখেছে। অসংখ্য মামলার মধ্যে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বৃদ্ধা ধর্ষণের অভিযোগেও মামলা হয়েছে। জেল খাটা মিলন তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়েও মনোনয়ন পাননি। তার আসন চড়া নিলামে উঠেছে। সুনামগঞ্জ-৫ আসনে অশ্রুসজল বিক্ষুব্ধ কর্মীদের প্রতিবাদ মিছিল থামাতে গিয়ে দলের জেলা সভাপতি কলিমউদ্দিন মিলন রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছেন। অসু্স্থ হয়ে এখন হাসপাতালে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু পড়াশোনা জানা সাবেক এমপিই নন গত ১০টি বছর দুঃসময়ে দলের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। তার ভাগ্যেও মনোনয়ন জোটেনি। নারায়ণগঞ্জ-২ এ আতাউর রহমান আঙ্গুর বা মাহমুদুর রহমান সুমনের ত্যাগের মূল্য হয়নি। বাণিজ্য করেছেন নজরুল ইসলাম আজাদ। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের মতো ত্যাগী নেতাও মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স মনোনয়ন পাননি।
দলের সহআন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা মেধাবী, বাগ্মী। দুঃসময়ে লড়েছেন। মনোনয়ন নায়ক-নায়িকা পেলেও রুমিন পায় না। দুর্দিনের সেই সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে নিরন্তর লড়লেও মনোনয়ন পায়নি। সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন নবী খান সোহেলরা নির্যাতিত হবে। মনোনয়ন পাবে না। কী অদ্ভুত।
অসংখ্য মনোনয়ন বাণিজ্যের ঘটনায় বিএনপিতে নেতা-কর্মীদের হতাশা তীব্র হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়লেও মনোনয়ন ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছে বিএনপির কাছে ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের চেয়ে যেমন জামায়াতের পাল্লা ভারী তেমনি মনোনয়ন বাণিজ্য করা অদৃশ্য শক্তি ক্ষমতাধর।
এদের জন্য বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট সবমিলিয়ে এখন পাপের বোঝা বইছে। পাপের শক্তিকে নিয়ে যেখানে রাজনৈতিক বা দলীয় শক্তিরই কল্যাণ আসে না সেখানে এরা ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব?
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন