শান্তির ভোটে বর্জনের কালি

বর্জন, পুনর্নির্বাচনের দাবি, জাল ভোটসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এবং বিচ্ছিন্ন গোলযোগের মধ্য দিয়ে গতকাল সোমবার তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয়েছে। প্রাথমিক ফলাফলে তিন সিটির মধ্যে রাজশাহী ও বরিশালে নৌকা ফিরলেও সিলেটে ধানের শীষ বিজয়ের পথে রয়েছে। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বিপুল ভোটে বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে হারিয়ে মেয়র পদ ফিরে পান। বরিশালে আওয়ামী লীগের সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ারকে বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। আর সিলেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে মেয়র পদ প্রায় নিশ্চিত করেন বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী।

সিলেটে আরিফুল হক ১৩২ কেন্দ্রে ৯০ হাজার ৪৯৬ ভোট এবং বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ৮৫ হাজার ৮৭০ ভোট পেয়েছেন। বিশৃঙ্খলার জন্য দুই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে। কেন্দ্র দুটির মোট ভোট চার হাজার ৭৮৭। চার হাজার ৬২৬ ভোটে এগিয়ে থাকা আরিফকে হারাতে হলে পুনর্নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়তে হবে এবং কামরানকে প্রায় সব ভোট পেতে হবে।

খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মতো এ তিন সিটির নির্বাচনেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া অন্য প্রার্থীদের এজেন্ট অনেক কেন্দ্রে উপস্থিত ছিল না। তবে সিলেটের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে জামায়াতের এজেন্ট ছিল। সিলেটের দুটি কেন্দ্রে সংঘর্ষ ঠেকাতে পুলিশের গুলি করার ঘটনা ঘটে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটও আহত হয়েছেন। তবে বিচ্ছিন্ন এসব ঘটনা ছাড়া নির্বাচনী এলাকাগুলোর পরিবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। তিন সিটির মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে বরিশালে একটি কেন্দ্রের ভোট বাতিল ও ১৫ কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে। সিলেটে স্থগিত করা হয় দুটি কেন্দ্র।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার দাবি, কিছু অনিয়ম ছাড়া বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সার্বিকভাবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘সব মিলিয়ে নির্বাচন ভালো হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট। যেখানে সমস্যা ছিল সেখানে তো আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।’

বিএনপি এ নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন দাবি করে বলেছে, ‘রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে নাটকীয় ভোট সন্ত্রাসের পরিস্থিতি দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল। রাজ বেতনভোগী কর্মচারী নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিল—তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নয়, তারা অবৈধ সরকারের প্রতিনিধি। সুতরাং অবৈধ সরকারের হুকুম তামিল করা ছাড়া তারা অন্য কোনো কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করতে আসেনি।’

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির লক্ষ্য ছিল এ নির্বাচনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করা। তবে এই অপচেষ্টা সফল করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রংপুর সিটির মতো প্রশংসিত নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন এ তিন সিটিতেও সক্ষম হয়নি। আবার কারো মতে, এ নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ঘটেনি—এটাই নির্বাচন কমিশনের সফলতা।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ নির্বাচন সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমি মনে করি ‘খুলনা মডেল’ গাজীপুরের পর এ তিন সিটিতেও প্রয়োগ হয়েছে। খুলনা ও গাজীপুরে নীরব নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হলেও এ তিন সিটিতে নীরবতার পাশাপাশি কিছু এলাকায় সরব নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের ঘটনাও ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন আমাদের বিতর্কিত নির্বাচন উপহার দিল। এর পরিণতি মঙ্গলজনক হবে না। নির্বাচন কমিশনের প্রতি এর মাধ্যমে জন-অনাস্থা বাড়ল।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, সুজনের পক্ষ থেকে তিন সিটিতে ৬০০ জন ভোটারের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। এদের ৯২ শতাংশই বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক এ বিষয়ে বলেন, সর্বিকভাবে এ তিন সিটির নির্বাচন ভালো হয়েছে। হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ভোটের বাক্স নিয়ে দৌড় দেওয়ার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। নির্বাচনে আকস্মিক ছোটখাটো কোনো সংঘর্ষ নিবারণযোগ্য অপরাধ নয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করার থাকে না। কিন্তু এই তিন সিটির নির্বাচনে আল্লাহর মেহেরবানিতে অনিবারণযোগ্য অপরাধের ঘটনাও ঘটেনি।

এদিকে তিন সিটিতেই বিএনপিসহ একাধিক মেয়র পদপ্রার্থী তাঁদের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। সিলেটে বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থী ভোট বাতিলের দাবি জানান। রাজশাহীতে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার এবং মেয়র পদের ব্যালট পেপার না পাওয়ার অভিযোগে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল একটি ভোটকেন্দ্রে অবস্থান নেন এবং নিজে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তিনি বলেন, যেখানে রাষ্ট্রের কর্মচারীরা ভোট চুরির সঙ্গে জড়িত সেখানে আমার ভোটের দাম নেই। এই বিপন্ন গণতন্ত্রে আমি আমার ভোট পর্যন্ত দিইনি।’

বরিশালে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী মো. মজিবর রহমান সরোয়ার দুপুরের দিকে এক সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। দুপুর পৌনে ১টা ও সোয়া ১টার দিকে জাতীয় পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী মো. ইকবাল হোসেন তাপস ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) প্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তী রিটার্নিং অফিসারের কাছে ভোটগ্রহণ স্থগিতের লিখিত দাবি জানান। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী আবুল কালাম দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জন করেন। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ওবায়দুর রহমানও অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।

বরিশালে বাসদের মেয়র পদপ্রার্থী ডা. মনীষা চক্রবর্তী তাঁর ওপর হামলা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘সদর গার্লস স্কুল কেন্দ্রে এসে আমরা দেখলাম যে সব ব্যালটে মেয়র পদপ্রার্থীর পক্ষে নৌকায় সিল দেওয়া। বিষয়টি প্রিসাইডিং অফিসারকে জানালে উনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এরপর যখন আমরা ব্যালট পেপারগুলো দেখছিলাম তখন আওয়ামী লীগের ব্যাজ পরা দুজন আমাকে ধাক্কা মেরে পেছন থেকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে এবং আমার হাত থেকে ব্যালট নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। একজন লাল পাঞ্জাবি এবং আরেকজন নীল শার্ট পরা ছিল। আমার কাছে তাদের ছবিও আছে। একজন মেয়র প্রার্থীকে যদি তারা এভাবে আঘাত করে তাহলে তো এই নির্বাচন করার আর কোনো অর্থ থাকে না।’

বরিশালে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভ করার সময় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ওবায়দুর রহমান মাহবুবের সমর্থকদের ওপরও হামলার অভিযোগ ওঠে।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোটের আগের রাতেই ৪৬ নম্বর সিলেট ইনক্লুসিভ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের বাইরে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৯ রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। সিলেটের রিটার্নিং অফিসার মো. আলীমুজ্জামান সকালে ভোটগ্রহণ শুরুর পর এ তথ্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে জানান। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষকরা মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য জানালেও তা আমলে না নিয়ে ইসি সচিবালয় থেকে ওই সব তথ্য লিখিতভাবে জানাতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা লিখিতভাবে সেসব তথ্য জানাননি।

কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গতকাল বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনসহ মোট সাতটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এর আগে গত বছরের ৩০ মার্চ কুমিল্লা, ২১ ডিসেম্বর রংপুর, চলতি বছরের ১৫ মে খুলনা ও ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশেনের নির্বাচন হয়। এসব নির্বাচনের মধ্যে সব পক্ষের কাছে সব চাইতে প্রশংসিত নির্বাচন ছিল রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন।

এসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন বিষয়ে ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলে আসছিলেন, এই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলসহ সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের সুযোগ পাবে বর্তমান কমিশন। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠেয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল নির্বাচনী রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলেও তাদের ধারণা ছিল।–কালের কন্ঠ