কুষ্টিয়া আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হওয়ার পর আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এক উগ্র সাম্প্রদায়িক হুমকি দিয়েছেন, যা এই ডামাডোলে আড়ালে পড়ে গেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের জ্বালানি উপদেষ্টা হিন্দুদের চামড়া তুলে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে হামলার ঘটনায় প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়।
এই ভিডিওটি আছে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায়। তবে মাহমুদুর রহমানের এই হুমকি বা উক্তির বিষয়টি গণমাধ্যমে সেভাবে আলোচিত হয়নি।
অবশ্য সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে কেউ কেউ এই বিষয়টি তুলেছেন, যেটা আবার মাহমুদুর রহমান এক ভিডিও বার্তায় অস্বীকার করেছেন।
গত রবিবার মানহানির এক মামলায় জামিন আবেদন করতে কুষ্টিয়া আদালতে যান মাহমুদুর রহমান। আদালত কক্ষে বেশ কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে থাকার পর বিকালে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন তিনি। কিন্তু আদালত চত্বরেই তার গাড়িতে হামলা হয়।
হামলাকারীরা ইট, লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ির কাঁচ ভাঙতে থাকে এবং ভেতরে বসে থাকা মাহমুদুর রহমান এ সময় রক্তাক্ত হন।
হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পরই মাহমুদুর রহমানকে ধরে আবার আদালত ভবনে নেয়া হয় এবং সেখানেই তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে হিন্দুদের চামড়া তুলে নেয়ার কথা বলেন
তবে বিএনপি সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা এই ঘটনায় কেন হিন্দুদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন সেটা স্পষ্ট নয়।
তবে কথাটি মাহমুদুর রহমান স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সামনেই বলেছেন।
রক্তাক্ত অবস্থায় মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, ‘ওসি সাহেব দেখেন। ৬৫ বছর বয়স আমার। সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী (আসলে ছিলেন উপদেষ্টা)।’
‘বাংলাদেশের জন্য জীবন দিব, যত সব দিল্লির কুকুর। বাংলাদেশের জন্য জীবন দিব, একাই জীবন দিব। চামড়া তুলে নেব হিন্দুদের। মারো দিল্লির হুকুমে মারো।’
এ সময় উপস্থিত সবাই তাকে শান্ত হতে বললে তিনি আরো উত্তপ্ত হয়ে কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
এ সময় বিপ্লব বলেন, ‘এসব কথা পাকিস্তান গিয়ে বলেন।’
তখন মাহমুদুর তেড়ে গিয়ে বলেন, ‘আপনারা ইন্ডিয়া যান। দিল্লি গিয়ে পা চাটেন।’
মাহমুদুর রহমান এমন ধর্মীয় উগ্রবাদী বক্তব্য প্রায় তিনি দিয়ে থাকেন। এর আগে মাহমুদুর রহমান সম্পাদিত ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় মুসলিম পবিত্র স্থান কাবার গিলাফ পরিবর্তনের একটি ছবিকে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। সেখানে আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে ‘কাবা শরিফের ইমামদের মানববন্ধন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছবিসহ প্রকাশ করা হয়।
তৎকালীন তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও ছবি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের শামিল বলে বলে দাবি করে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ চলার সময় অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চকে ঠেকাতে ধর্মীয় উস্কানিমূলক বহু লেখা প্রকাশ করেছিলেন মাহমুদুর। গণমাধ্যমে নজিরবিহীন এসব লেখনির কারণে সে সময় উগ্রপন্থা ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
সে সময় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলায় গ্রেপ্তার হন মাহমুদুর। বন্ধ করে দেয়া হয় আমার দেশ পত্রিকা।
কুষ্টিয়ায় মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার ঘটনায় যেমন নিন্দা হচ্ছে, তেমনি তার উগ্র সাম্প্রদায়িক হুমকির কারণেও সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রমেশ চন্দ্র দত্ত ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান যে হিন্দুদের দেখে নেবার হুমকি দিয়েছেন সেই ভিডিও ফুটেজ আমরা দেখেছি। কেন্দ্রীয় কমিটিও সেটা দেখে পর্যালোচনা করছে। তারা নির্দেশনা দিলেই আমরা মামলা করব।’
কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াছির আহমেদ তুষার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘উনি (মাহমুদুর রহমান) হলেন জামায়াত বিএনপির অর্থ বহনকারী মদদপুষ্ট। জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়ার জন্য তিনি এই ধরনের কথা বার্তা বলে থাকেন। তার এই বক্তব্য নিয়ে আমাদের আইনজীবীরা মামলার জন্য আলোচনা করছেন।’
‘তার বিরুদ্ধে ১২৫টি মামলা দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কারণ, তিনি একেক সময় একেক কথা বলেন এবং কথা বার্তা ভালো না।’
কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি ভিডিও ফুটেজ দেখিনি তাই এই বিষয় কিছু বলতে পারব না। আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয় কেউ থানায় অভিযোগও দেয়নি।’
পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আমি ফুটেজ দেখিনি।’
মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপি নেতারা পরদিন থেকেই নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এই হামলার বিচারের পাশাপাশি মাহমুদুর রহমানের মতের সঙ্গে মিল আছে বলেও জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে তিনি হিন্দুদের চামড়া তুলে নেয়ার হুমকির বিষয়টি জানেন কি না, সেটি অবশ্য বলেননি।
মাহমুদুরের অস্বীকার
২৫ জুলাই হাসপাতালে বসে ফেসবুকে এক ভিডিওতে অবশ্য মাহমুদুর রহমান হিন্দুদের চামড়া তুলে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি একে অপপ্রচার বলেছেন। চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন এই কথা প্রমাণের।
বেমালুম অস্বীকার করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিয়ে কোনো মন্তব্য আহত অবস্থায় করি নাই। এবং যারা আমার সমস্ত বক্তব্য ইউটিউবে আছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে আছে, অবিকৃতভাবে আছে। এবং যেখানে অবিকৃতভাবে আছে, সেখানে আমি চ্যালেঞ্জ করেছি, কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করি নাই।
এরা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে এই ঘৃণ্য গোষ্ঠী যারা অন্যের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা ফ্যাসিস্ট, যারা অন্যের বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা মিডিয়ার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, যারা মানুষের ফান্ডামেন্টাল রাইটসে বিশ্বাস করে না, তারা তাদের মতবাদ চাপিয়ে দেয়ার জন্য এই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে।
মাহমুদুর বলেন, ‘আমি বলেছি ধর্মীয় অধিকারের কথা। যেটা ইউএন…জাতিসংঘ যেটা বলেছে, ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন, আমি সেটার কথা বলেছি। আমাদের যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এখানে, তারা ইসলাম ধর্মের। আমি নিজেও ইসলাম ধর্মের। আমারও ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন রয়েছে।’
বর্তমান সরকার ইসলামের ওপর আক্রমণ করেছে। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। আমি সেই কথাই বলেছি। যে ইসলামে আমি বিশ্বাস করি, সেই ইসলামের জন্য প্রয়োজনে আমি জীবন দেব।’–ঢাকাটামস