দিনাজপুর বড়পুকুরিয়ার কয়লা খনি থেকে কোটি টাকার কয়লা গায়েব। কোল ইয়ার্ডে কাগজে-কলমে কয়লার মজুদ এক লাখ ৩০ হাজার টন থাকলেও বাস্তবে রয়েছে মাত্র ১৪ হাজার টন। ‘গায়েব’ কয়লার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এ ঘটনায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রতিনিধি বিষয়টি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে গেলে কোল ইয়ার্ডে মজুদের ঘাটতি ধরা পড়ে। এরপর তৎপর হয় পেট্রোবাংলা। এ ঘটনায় বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির (বিসিএমসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদ ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও কোম্পানি সচিব) আবুল কাশেমকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও ডিজিএম (ভাণ্ডার) একেএম খালেদুল ইসলামকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পেট্রোবাংলার এক অফিস আদেশে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। হাবিব উদ্দিন আহমদকে খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে অপসারণ করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। কোম্পানি সচিব আবুল কাশেমকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে (সিরাজগঞ্জ) বদলি করা হয়। বড়পুকুরিয়া খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পরিচালক আইয়ুব খানকে। ঘটনা তদন্তে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে কয়লা সংকটের কারণে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে বলে পিডিবি জানিয়েছে।
খনি সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়। দীর্ঘ ১৩ বছরে কয়লা উত্তোলন হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টন। বর্তমানে কোল ইয়ার্ডে কয়লার মজুদ থাকার কথা এক লাখ ৩০ হাজার টন। কিন্তু বাস্তবে কয়লার মজুদ পাওয়া গেছে ১৪ হাজার টনের মতো। এক লাখ ১৬ হাজার টনের মতো কয়লার কোনো হদিস নেই। যার বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন থেকে একটি চক্র চুরি করে খোলা বাজারে এসব কয়লা বিক্রি করে দিয়েছে।
পিডিবির সূত্র জানায়, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রে বর্তমানে তিনটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে দুটো পুরনো ও একটি নতুন। পুরনো দুটির প্রতিটি ১২৫ মেগাওয়াটের। তবে এগুলোর বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ৮৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে এক নম্বর ইউনিটটি মেরামতের জন্য বন্ধ রয়েছে। নতুনটির উৎপাদন ক্ষমতা ২৭৪ মেগাওয়াট। চালু দুটি ইউনিট দিয়ে গত জুন মাসের প্রথম দিকে গড়ে ৩৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছিল। কয়লা খনির উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ১৭ জুন এ দুই ইউনিট থেকে ৩৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এ দুটি ইউনিট চালাতে দিনে সাড়ে তিন হাজার টন কয়লা লাগে। উৎপাদন বন্ধ থাকায় কয়লার সরবরাহ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে বিদ্যুতের উৎপাদনও কমতে থাকে। ২৫ জুন বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ২৩০ মেগাওয়াট। পরে ২৯ জুন থেকে কর্তৃপক্ষ পুরনো ইউনিটটি বন্ধ করে শুধু নতুন ইউনিটটি চালু রাখে। ১৫ জুলাই এই ইউনিট থেকে ১৯০ মেগাওয়াট এবং ১৯ জুলাই শুক্রবার ১৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বর্তমানে যতটুকু মজুদ রয়েছে, তা দিয়ে একটি ইউনিট চালালেও আর দু-তিন দিন বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। নতুন করে কয়লা উত্তোলন শুরু হতে পারে আগস্টের শেষে। ফলে প্রায় এক মাস কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ থাকবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির সদ্য সাবেক এমডি প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ১৭ একর জায়গার ওপর কোল ইয়ার্ড নির্মিত। দীর্ঘ এক যুগেও উত্তোলিত কয়লার মজুদ পরিমাপ করা হয়নি। শুধু কাগজে-কলমে কয়লার মজুদ হিসাব করা হতো। দীর্ঘদিন কয়লা পড়ে থাকলে আগুন ও পানিতে নষ্ট হয়ে ওজন কমে যায়। তা ছাড়াও অনেক কয়লা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। সিস্টেম লস থাকে শতকরা দেড় ভাগ। নানা কারণে কয়লার ঘাটতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।