যে এলাকায় আছে এক লম্বা ‘কনডম গলি’, বেছে কিনতে শিখুন

ভারতের অন্যতম প্রচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কলকাতা । এই কলকাতার ভিতরে কি আর একটা জাদুনগরী রয়েছে, যার নাম ‘ধর্মতলা’? শহর কলকাতার বাসিন্দারা সেই ম্যাজিক্যাল সিটির খবর ততটা রাখতেন না, যতটা রাখত মফস্বল থেকে আসা ছেলেরা। ‘ছেলেরা’ লিখলাম এই কারণেই যে, মেয়েদের পক্ষে সেই জাদুনগরীর বাস্তবতাকে ছোঁয়া সম্ভব নয়। বাধা ছিল, নিষেধের লাল চোখ ছিল। এই বিশ্বায়নের যুগেও সেই সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মেয়েরা সেই ‘জানাডু’ আবিষ্কারে সামিল হতে পারেনি। সেই ‘সাংগ্রিলা’ আজও রয়ে গিয়েছে একান্ত ভাবে ছেলেদের।

দূর বা কাছের মফস্বল শহর থেকে কলকাতায় আশ্রয় খুঁজে ফিরত কিশোর। কখনও গড়ের মাঠের সবুজ কার্পেটে দাপানো চামড়ার ফুটবল, কখনও নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউজ, গ্লোব, মেট্রো ইত্যাদি সিনেমা হল তাকে দিত সেই আশ্রয়। অনাদির মোগলাই বা নিছক ভেলপুরিতেই সে পেয়ে যেত অমৃতের আস্বাদ। তার পরে পায়ে হেঁটে শহর আবিষ্কারের নেশায় সে ঘুরত এ গলি-সে গলি। এমনই একদিন তার সামনে একটা গলি মেলে ধরত এমন এক জগৎ, যার জন্য কোনও প্রস্তুতি সে তখনও পর্যন্ত নেয়নি। তার চোখের সামনে ঝলসে উঠত এমন সব বিষয় যা তাকে এক পলকেই ‘যুবক’ করে তুলত। তার কৈশোর, তার সং অফ ইনোসেন্স পড়ে থাকত শহরের হাইড্র্যান্টে, সেখান থেকে তা গলে যেত, শহরের পয়ঃপ্রণালী দিয়ে বয়ে তা গিয়ে পড়ত গঙ্গায়।

মোতি শীল স্ট্রিট তেমনই এক রাস্তা। কর্পোরেশন আর রিগ্যাল সিনেমা হলের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা নিউমার্কেটের দিকে গিয়েছে, তার ঠিক উল্টো দিকের পথটির পোশাকি নামই মোতি শীল স্ট্রিট। সোজা এই পথ গিয়ে মেশে চাঁদনি চকে। প্রকাশ্য রাস্তা। কোনও ছমছমে কিংবদন্তিও নেই এই গলিকে ঘিরে। তবু কেন এই গলিতেই কিশোর খুঁজে পেয়েছিল তার প্রথম যৌবনবেদনাকে?

‘কনডম গলি’। কলকাতা ও সন্নিহিত মফস্বলের তারুণ্য এই নামেই ডেকে এসেছে মোতি শীল স্ট্রিটকে। গলির গোড়ায় বেশ কয়েকটি ‘রাবার গুডস’-এর দোকান। তাদের শোকেস-এ একদা শোভা পেত এমন সব মোড়কের পণ্য, যাদের দেখলে কান লাল হয়ে উঠত। হ্যাঁ সেই যুগ, যখন ‘কনডম’ শব্দটারও তেমন চল ছিল না। তাকে ‘নিরোধ’ নামে ডাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করত শহরতলি-মফস্বলের ছেলেছোকরারা। নিরোধ, ১৯৬৮-পরবর্তী ভারতবর্ষ আর পরিবার পরিকল্পনার লাল ত্রিকোণের সমার্থক সেই হলুদ প্যাকেটের সামগ্রী, যাকে হাতে নিয়ে পরখ করতে পারাটাই ছিল ‘বড় হওয়া’-র সিম্পটম। কনডমের বাংলা বা ভারতীয় সিনোনিম হল ‘নিরোধ’— এমন একটা ধারণা মাথায় গেঁথে যেত সেই সময়ে। ফ্যাকাশে হলুদ রংয়ের ‘নিরোধ’ দেখে অভ্যস্ত চোখের সামনে যখন ঝলসে উঠত স্বল্প অথবা বিস্রস্তবসনা উদ্ভিন্ন যৌবনাদের ছবি, তখন তার সামনে হতচকিত হওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা থাকত না।

খেলা শেষে মাঠের বাইরে যখন জমে উঠত নিষিদ্ধ বিষয়ের আড্ডা, তখন বয়সে বড় কেউ শোনাত— এসব হল লাক্সারি নিরোধ। এ তোমাদের পাতি মাল নয়। নিরোধেরও লাক্সারি! কানে তখন পিছলে যাচ্ছে সেই পাড়াতুতো দাদার বাক্য— ও সব ইম্পোর্টেড মাল। ধর্মতলা ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। হেব্বি দাম। ওসব কারা কেনে জানিস? ধর্মতলার হোটেলে যে সব ফরেনাররা ওঠে, তারা। ধর্মতলায় তো গ্র্যান্ড হোটেল! সেখান থেকে বেরিয়ে মোতি শীল পর্যন্ত গড়িয়ে আসে কোন ফরেনাররা? কেন তারা নিরোধ কেনে? কারা সঙ্গিনী হয় তাদের? তারাও কি বিদেশিনী? নাকি ছমছমে পোশাকে দেখা সেই সব আবছায়া মেয়েরা, যাদের মুখ কোনওদিন দেখাই হয়নি?

উত্তর মিলত না সহজে। মোতি শীল দিয়ে পাস করার সময়ে অবধারিত ভাবে চোখ চলে যেত সেই সব দোকানের শোকেসে। স্বর্ণকেশী, বিলোলকটাক্ষী সেই সব হুরি-পরির দলকে দেখে কানের দু’পাশ দপ দপ করত, শীতেও বিন বিন করে নামত শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম।

কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল তাঁর এক কবিতায় ফুলঝুরি আর রংমশালের মোড়কে উদ্ধৃত স্বল্পবসনা সুন্দরীদের কথা লিখেছিলেন। তারা মারাত্মক। কিন্তু ওই সব সুন্দরীদের চাইতে ঢের বিপজ্জনক ছিল ‘কনডম সুন্দরী’রা। নীলছবি তখনও সুলভ হয়নি। নারী-নগ্নতার প্রথম পাঠই দিয়েছে মোতি শীল স্ট্রিট— একথা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই।

‘রিগ্যাল’ সিনেমায় সেই সময়ে ছলত ছমছমে সব ছবি। ‘জওয়ানি কি জলওয়ে’, ‘সিক্রেট অফ সেক্স’ ইত্যাদি। আর সেই হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত কয়েকজন বারনারী। তাঁদের ডাকনাম যে ‘হুকার’, তা তখন কম লোকেই জানত। এহেন পরিবেশে কতিপয় রাবার গুডস-এর দোকান যেন সোনায় সাহাগার উপরেও কিছু বেশি। এমন রাস্তাই তো চুরমার করে দিতে পারে কৈশোরের ইনোসেন্সকে! সেটাই ঘটাত মোতি শীল স্ট্রিট ওরফে ‘কনডম গলি’। ‘কনডম’ শব্দটাই তখন দারুণ ট্যাবু। কনসেপ্টটাও। এই গলি দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানে নিষেধের পরে নিষেধকে টপকানো।

তার পরে কলকাতার পয়ঃপ্রণালী দিয়ে বয়ে গিয়েছে গ্যালন গ্যালন ঘোলাজল। কনডম আর তত অধরা নয়। কানাঘুষো পেরিয়ে একথাও শোনা যায়, ওই সব দোকানে নাকি সন্ধান মেলে সেক্স টয়ের। না ততদূর যেতে পারেনি বাঙালি মধ্যবিত্ত। ‘নাকি’-তেই আটকে থেকেছে কল্পনা। কনডম তো আজ স্পেনসার্স-এও পাওয়া যায়। আর ভারতীয় ব্র্যান্ডেও দেহ মেলে ধরেন দেশি সুন্দরীরা। ‘লাক্সারি’ শব্দটারও আর ততটা ধার নেই এই ডটেড, ফ্লেভার্ড, রিবড-এর বাজারে। কিছুই এক্সক্লুসিভ নয় আজ। মোতি শীলও নয়। কৈশোরও নয়। ক্লাস সেভেনের ছেলেটিরও হাতে নিয়ে কনডম দর্শনের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। রোমাঞ্চ এখন নিছকই আভিধানিক।

তবু শহর তাকে লালন করে। মোতি শীল তার সম্ভার নিয়ে অপেক্ষা করে আজও। ময়দানের না হওয়া ফুটবল খেলার শেষে, বন্ধ লাইটহাউসের সামনে থেকে নস্ট্যালজিয়াকে সঙ্গে নিয়ে অনাদি মোগলাইয়ের বিলীয়মান অস্তিত্বকে মনে রেখে কোনও প্রৌঢ় যদি প্রবেশ করেন এই রাস্তায়, আমি নিশ্চিত মোতি শীল তাঁর সামনে মেলে ধরবে সেই সব শরীর, সেই সব শরীরী জলতরঙ্গ, সেই সব তরঙ্গায়িত নারী বিভঙ্গ, যাদের এক ঝলক দেখেই একদা ছিটকে পড়েছিল কৈশোর নর্দমায়, এক লহমায় কিশোর যুবক হয়ে উঠেছিল। তার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল এক আশ্চর্য জাদু নগর, যার সন্ধান সে ছাড়া আর কেউ জানত না।