কোনো পুরুষের সাথে কোনো নারীর শারীরিক সম্পর্কের ফলে মানব ভ্রুনের নিষেক ঘটে। পরে নির্দিষ্ট সময় গর্ভধারণের পর প্রসবের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হয়। নারী-পুরুষের বয়স, দুর্বল জীবনব্যবস্থা, যৌন সংক্রমণের ইতিহাস প্রভৃতি সন্তান উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রজনন বিশেষজ্ঞদের মতে, সুনির্দিষ্ট কিছু খাদ্যাভাসও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডায়েট আপনার ডিম্বাশয় এবং প্রজননে প্রভাব ফেলে। সাধারণভাবে ভালো চর্বি বিশেষ করে মাছ এবং অ্যাভোকাডো আপনার ডিম্বাশয়ের পরিস্ফূটন ঘটাতে সাহায্য করে। অন্য দিকে, চর্বি বিশেষ করে লাল মাংস এবং ভাজা খাবার আপনার ডিম্বাশয়ে ডিমের উৎপাদন কমিয়ে আনে। এগুলো ছাড়া খাদ্যশস্য এবং প্রোটিন জাতীয় খাবারও কিন্তু প্রজনন পদ্ধতিতে প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, আপনি নিয়মিত কিভাবে খাচ্ছেন, কোন ধরনের খাবার খাচ্ছেন, কী পান করছেন এসবও কিন্তু গর্ভধারণের সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোই নাটকীয়ভাবে আপনার প্রজননে প্রভাব ফেলে।
পর্যাপ্ত না খাওয়া
কাজের চাপে পড়ে মাঝেমধ্যে দুপুরের খাবার খাওয়াই ভুলে যান। এই অভ্যাসই কিন্তু আপনার প্রজননে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্যাপ্ত না খাওয়ার কারণে আপনি পুষ্টিহীনতায় ভুগে থাকেন। পাশাপাশি চাপ তো আছেই। সব মিলিয়ে শরীরের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে, যা প্রজননে প্রভাব ফেলে। ডিম্বাণু উৎপাদনের জন্য শরীরে পুষ্টির প্রয়োজন পড়ে। এ কারণে প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি সঙ্গীকেও একই খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
খাবারে এলার্জি
যেসব খাবারে এলার্জি আছে সেগুলোও প্রজননে প্রভাব ফেলে। কেননা কিছু এলার্জি আছে যেগুলো শরীরের তাপমাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাবার গ্রহণের ফলে এলার্জির প্রতিক্রিয়ার কারণেই আসলে এমনটি হয়ে থাকে। তাই প্রজনন ভালো রাখতে এলার্জি সৃষ্টি হয় এমন খাবারের পরিবর্তে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
প্লাস্টিক কন্টেইনারের খাবার গ্রহণ
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্লাস্টিকের কোনো প্যাকেটের খাবার খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা জরুরি। এসব প্যাকেটে ক্ষতিকর নানা কেমিক্যাল থাকায় তা প্রজননে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই যতটা সম্ভব এসব খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
হারবাল ওষুধ সেবন
প্রাকৃতিক এবং স্বাস্থ্যকর হওয়ায় অনেকেই মনে করেন হারবাল ওষুধ সেবন অনেক ভালো। তাতে নানা রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আসলে এতে কোনো নাটকীয়তা নেই বরং এর চেয়ে ভালো হয় যদি আপনি ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খান। মনে রাখবেন, প্রজনন সংক্রান্ত সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের সবচেয়ে বেশি জরুরি ফলিক অ্যাসিড খাওয়া। এটি শরীরের কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করার জন্য অনেক বেশি জরুরি। একই সাথে স্বাস্থ্যকর ও ভারসাম্যপূর্ণ ডায়েট বিশেষ করে ভিটামিন, মিনারেল, স্বাস্থ্যকর চর্বি, ফল, সবজি প্রভৃতি খাবার খাওয়াও জরুরি।
অতিরিক্ত মাছ এবং শাকসবজি খাওয়া
২০১৮ সালে হিউম্যান রিপ্রোডাকশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী গর্ভধারণের জন্য শতকরা ৬৫ থেকে ৬৮ ভাগ ডায়েট অনুসরণ করে চলেন তারা ডায়েট অনুসরণ করেন না তাদের চেয়ে সহজেই গর্ভধারণে এবং সন্তান জন্মদানে সক্ষম হন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য স্বাস্থ্যকর চর্বি, তাজা ফল এবং শাকসবজি, খাদ্যশস্য, ডাল, মাছ খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। সুনির্দিষ্ট একটি ডায়েট প্ল্যান মানে এই নয় যে, স্বাস্থ্যকর খাবারগুলোই আপনাকে মাত্রাতিরিক্ত খেতে হবে। এতেও হিতে বিপরীত হতে পারে।
নন-অর্গানিক খাবার খাওয়া
প্রজনন স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে অর্গানিক সমৃদ্ধ খাবার। এ ক্ষেত্রে অর্গানিক ডেইরি পণ্যকে এগিয়ে রাখেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, নন-অর্গানিক দুধের তৈরি খাবার খেলে তা আপনার ডিম্বাশয়ে প্রভাব ফেলে। এর ফলে প্রজননওক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৭ সালে হিউম্যান রিপ্রোডাশন জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্ন ডেইরি পণ্য যেমন : স্কিম দুধ এবং দইয়ের চেয়ে চর্বিযুক্ত দুধ এবং আইসক্রিম খাওয়া প্রজননের জন্য অনেক ভালো।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ
আপনি যদি গর্ভধারণ করতে চান তাহলে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। জার্নাল ল্যানকেটে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী দিনে এক কাপের বেশি কফি পান করেন তাদের চেয়ে যারা কম পান করেন তারা আগেই গর্ভধারণ করেন। মনে রাখবেন, ক্যাফেইন শুধু কফিতে নয়, বরং সোডা, চকলেট এবং এনার্জি ড্রিঙ্কেও আছে। তাই অনেক সময় চাইলেও আপনি ক্যাফেইন গ্রহণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাই গর্ভবতী হতে চাইলে খাদ্যাভাসে কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি। চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে পারেন।
অধ্যাপক ডা: আইনুন আফরোজ
শিশুর জন্মের পর প্রথম আধা ঘণ্টা তার মায়ের দুধ টেনে খাওয়ার ক্ষমতা খুব বেশি থাকে। তাই জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করা দরকার। কোনো অবস্থাতেই পানি, মিসরি পানি, মধু বা অন্য দুধ দেয়া উচিত নয়। শিশু বাড়িতে হোক বা হাসপাতালে, নরমাল হোক বা সিজারিয়ান, জন্মের পরপরই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে মায়ের দুধ টানানো উচিত।
সঠিকভাবে বুকে ধরা
বসা অবস্থায় : মা যে দিকের দুধ খাওয়াতে চান সেই দিকের হাতের কনুইয়ের ভাজে শিশুর মাথা রাখবেন এবং হাতের তালুতে শিশুর পাছা ধরবেন। তারপর বুকের সামনে শিশুকে আড়াআড়িভাবে ধরবেন যাতে শিশুর ঠোঁট মায়ের দুধের বোঁটার কাছে পৌঁছায়। এ অবস্থায় মা অন্য হাত দিয়ে তার স্তন নিচের দিক থেকে আলতো করে তুলে ধরবেন। যাতে স্তনের বোটা শিশুর ঠোঁট স্পর্শ করে।
এ সময়ে তাড়াহুড়ো না করে একটু অপেক্ষা করতে হবে। প্রয়োজন হলে মা হাত দিয়ে চেপে সামান্য দুধ শিশুর ঠোঁটে লাগাতে পারেন। মুখে বোঁটার ছোঁয়া লাগলে শিশু দুধ খুঁজবে এবং হা করবে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। এ সময়ে জোর করে বোঁটা তার মুখে ভরার চেষ্টা না করে লক্ষ করতে হবে যে, সে মোটামুটি একটু বড় হা করেছে কিনা। বড় হা করার সাথে সাথে শিশুকে আলতো করে স্তনের সাথে মিশিয়ে ধরতে হবে। শিশু এই সময়ে মায়ের দিকে ফেরানো থাকবে। তার পেট মায়ের পেটের সাথে লাগবে। নাক এবং থুঁতনি মায়ের স্তনের সাথে ছোঁয়া লাগবে। মায়ের বোঁটা এবং বোঁটার পাশের কালো অংশের বেশির ভাগ শিশুর মুখের ভেতরে থাকবে। মুখ থাকবে বড় করে হা করা। এ অবস্থায় মায়ের বুকে ধরতে পারলে মায়ের দুধ পেতে শিশুর কোনো অসুবিধা হয় না।
শোয়া অবস্থায় : মা যেদিকের দুধ খাওয়াবেন সেদিকে কাত হয়ে শোবেন। শিশুকে তার বুকের কাছে টেনে আনবেন যাতে স্তনের বোঁটা শিশুর ঠোঁটে লাগে। শিশু বড় হা করলে তাকে আরো বুকের সাথে মিশিয়ে ধরতে হবে যাতে বোঁটা এবং বোঁটার পাশের কালো অংশের বেশির ভাগ তার মুখের ভেতরে ঢুকে যায়। তার পেট মায়ের পেটের সাথে মিশে থাকে। মায়ের এক হাত ভাজ করে তার নিজের মাথার নিচে দেবেন অন্য হাতে শিশুকে আলতো করে ধরে রাখবেন।
কতবার খাওয়াবেন : প্রথমদিকে মায়ের বুকে যে শালদুধ থাকে সেটা পরিমাণে কম হলেও গুণে অনেক সমৃদ্ধ। তাই শালদুধ অবশ্যই শিশুকে খাওয়াতে হবে। এই সময়ে যত ঘন ঘন মায়ের বুকে ধরা যায় ততই ভালো। কারণ, এতে শিশুর দুধ টানার অভ্যাসটা চালু হয়। তা ছাড়া বার বার টানার ফলে মায়ের দুধও বেশি করে নামতে শুরু করে। এখানে মনে রাখতে হবে যে, শিশু বোঁটা চুষলে মায়ের শরীরে এক ধরনের সাড়া পড়ে, ফলে দুধ তৈরি হতে শুরু করে। কাজেই দুধ নেই বলে বুকে টানাবেন না- এটা কিন্তু সঠিক চিন্তা নয়। নতুন শিশু সাধারণত একটু বেশি ঘুমিয়ে থাকে। তাই কিছুক্ষণ পরপর তাকে একটু নাড়াচাড়া দিয়ে জাগিয়ে বুকে ধরতে হবে। ঘুমিয়ে থাকলেও একটানা দু’ঘণ্টার বেশি যাতে না খেয়ে থাকে সেদিকে একটু খেয়াল রাখতে হবে। দিনে এবং রাতে উভয় সময়ে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে।
একবারে কতক্ষণ খাওয়াবেন : শিশুকে একবারে একদিকের দুধ খাওয়াতে হবে। প্রতিবারে দু’দিকেরই খাওয়াতে হবে, এ ধারণা সঠিক নয়। তবে একদিকের দুধ শেষ করে যদি তার পেট না ভরে তাহলে অন্য দিকেরটাও খাওয়ানো যেতে পারে। এভাবে অদল বদল করে দিনরাত একবার ডান একবার বাম আবার ডান আবার বাম এই নিয়মে খাইয়ে যেতে হবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো সময় নেই। যখন খুশি তখন মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন এবং যখন খুশি তখন শিশুও তার মায়ের দুধ খেতে পারে। তবে শিশু যদি সারাক্ষণই মায়ের দুধ টানতে চায় তখন খেয়াল করতে হবে সে বুকে ঠিকমতো লেগেছে কিনা।