নারীর ‘না’ বলা গোপন ঘাতক

স্তনে ব্যথা নিয়মিত অনুভূত হলে বা স্তনে অথবা বাহুর নিচে চাকা বা ল্যাম্প দেখা দিলে, ওই চাকার অথবা স্তনবৃন্ত থেকে রস বের হলে, পরিবারের অন্য কারো স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকলে, স্তনের কোথাও ফুলে গেলে অথবা লাল হলে, গর্ভধারণের বিভিন্ন উপসর্গের উপস্থিতি যে নিয়মিত ঋতুস্রাব না হলে মোটামুটিভাবে বুঝতে হবে ব্যক্তিটি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত

ইয়াসমীন রীমা

জেলা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ছোট্টগ্রাম ছাতিয়া। সে গ্রামের বড়ো মসজিদের মুয়াজ্জিন খলিলুর রহমানের একমাত্র কন্যা শেফালি খানম ওরফে শেফু। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না বিধায় মাত্র সতের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায় পাশের গ্রামের মতিন খলিফার ছেলে ওমান প্রবাসী সফিকের সঙ্গে। বিয়ের দু’মাস পর সফিক বিদেশে চলে যায়। বিয়ের ছয়মাস পর থেকে শেফুর বাম স্তনে মৃদু মৃদু ব্যথা অনুভূত হতো প্রায় সময়ে। প্রথম প্রথম তেমন গুরুত্ব দেয়নি সে। কিন্তু গেল দু’সপ্তাহ ধরে সেই ব্যথা মৃদু থেকে তীব্র আকার ধারণ করলো। অত্যন্ত পর্দানশিন পরিবারে শেফু বেড়ে ওঠেছে তাই লজ্জায় কাউকে বলেনি তার এই শারীরিক সমস্যার কথা। কিন্তু যন্ত্রণা যখন সহ্য করতে আর পারছিলো না, তখন এক সন্ধ্যায় সে তার স্বামীর বড়ভাইয়ের বউ বকুল ভাবীকে জানায়। বকুল ভাবী তার স্বামী সফিককে বিষয়টি অবহিত করলে সে উপজেলার কোনো ডাক্তারকে দেখাতে অনুরোধ করে। বকুল অনেক অনুনয়-বিনয় করে আজ উপজেলা কমপ্লেক্সের মহিলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে। ডাক্তার প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়ে দিলো শেফালী স্তন ক্যান্সারে ভুগছে। জরুরি ভিত্তিতে তার উচ্চতর চিকিত্সা প্রয়োজন। নতুবা জীবন বিপন্ন হতে পারে।

কেবল শেফালী কেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক নারী স্তন ক্যান্সারে ভুগছে। কেবল সামাজিক কুসংস্কার ও তথ্য না জানার কারণে অকালে ঝরে পড়ে মৃত্যু কোলে। তাছাড়া সঠিক খাদ্যাভাব ও সুষ্ঠু জীবন-যাপন প্রক্রিয়ার কারণে উন্নত বিশ্ব অপেক্ষা দেশে অধিক সংখ্যায় নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এর মধ্যে ১৫.৫০% (Women Health Organisation চলতি জরিপ) তরুণী। তবে এসব তরুণী দেশীয় সবজি-ফলমূল না খাওয়ার অভ্যাসে ও মাত্রারিক্ত ফাষ্টফুড খাওয়ার কারণে এ শ্রেণিরা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে।

ঢাকা মহিলা সমিতির কাউন্সিলিং সভায় উপস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, উন্নত দেশগুলোতে ত্রিশ বছর পরে এমনিক চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর বয়সে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে উল্লেখিত বয়সের নারীদের স্তন ক্যান্সার হলেও তরুণীদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সার বেড়ে চলেছে। এসব টিনএজ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী গ্রাম শহর সব স্থানে লঙ্ঘিত হয়। বর্তমানের ভেজাল খাদ্য গ্রহণ তার অন্যতম কারণ। তাছাড়া বংশগত ক্যান্সার ছাড়াও শহরে এই বয়সের তরুণীদের মধ্যে ফাষ্টফুড অগ্রহীতা স্তন ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ায়। উপরন্তু আজকাল টিনএজরা অট্টালিকা বা ভবনে ওঠার সময় সিঁড়ি না ভেঙে লিফট বা এক্সসেলেটার ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে একটুও কায়িক পরিশ্রম করতে আগ্রহী নয়। তাছাড়া বিভিন্ন রকম মাদকাসক্তও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

এ্যাপোলে হাসপাতালের কো-অর্ডিনেটর অ্যান্ড কনসালট্যান্ট জেনারেল অ্যান্ড ল্যাপারোস্কোপিক সার্জারি বিভাগের প্রফেসর ডাঃ আনিসুর রহমান জানান, চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় স্তনে ব্যথা হওয়াকে বলা হয় ম্যাস্টালজিয়া। প্রতি ১০ জন মহিলার মধ্যে ৭ জন মহিলার জীবনে কোনো না কোনো সময় স্তনে ব্যথা হয়ে থাকে। তবে এ ব্যথা নিয়মিত অনুভূত হলে বা স্তনে অথবা বাহুর নিচে চাকা বা ল্যাম্প দেখা দিলে, ওই চাকার অথবা স্তনবৃন্ত থেকে রস বের হলে, পরিবারের অন্য কারো স্তন ক্যান্সার হয়ে থাকলে, স্তনের কোথাও ফুলে গেলে অথবা লাল হলে, গর্ভধারণের বিভিন্ন উপসর্গের উপস্থিতি যে নিয়মিত ঋতুস্রাব না হলে মোটামুটিভাবে বুঝতে হবে ব্যক্তিটি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাছাড়া নিয়মিত স্তন প্রদাহ সময়ের ব্যবধানে স্তনে ব্যথাই সাধারণত বেশি দেখা যায়। নারীর ঋতুস্রাব বা মাসিক শুরু হওয়ার পর থেকে যে কোনো বয়সেই এটা প্রথম হতে পারে, তবে সচরাচর দেখা যায় ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রথম ব্যথা অনুভূত হয়। নারীদের রজোনিবৃত্তি অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন মাসিক বন্ধ হয়ে যায় তখন এই ব্যথা অনুভূত হয় না। স্তনের ফাইব্যোসিসটিক পরিবর্তন কোনো প্রকার ল্যাম্প বা চাকার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও স্তন কোষকলা থেকে ব্যথা অনুভূত হওয়া টিউমার অথবা অন্য বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়া। স্তনের চেয়ে বরং বুকের নিচের দিকের বক্ষ প্রাচীর থেকে ব্যথা বেশি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে আবার মাছকুপেশি অথবা হাড়ের সমস্যা থেকে এ ধরনের ব্যথা হতে পারে।

আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যান পরিসংখ্যান মতে, দেশে প্রতিবছর স্তন ক্যান্সারে ১৭ হাজার ৭৮১ জন নারী আক্রান্ত হয় এবং ৮ হাজার ৩৯৬ জনের মৃত্যু ঘটে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অধিক হতে পারে। বিশেষভাবে শিল্প সমৃদ্ধ পাশ্চাত্য দেশগুলোতেই ব্রেস্ট ক্যান্সার বেশি দেখা যায়। এ-জন্য ব্রেস্ট ক্যান্সারকে Disease of Civilization বলা হয়ে থাকে। স্তন ক্যান্সারের চিকিত্সায় নিয়োজিত ও গবেষণারত চিকিত্সকের পরিসংখ্যান মতে, প্রতিবছর ৩৬ হাজার স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। যার মধ্যে টিনএজদের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ৫ শত। তবে সঠিক সরেজমিনের পরিসংখ্যানটি নেই বিধায় তাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি ক্যান্সার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাবেরা খাতুন টিনএজদের স্তন ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য বিষয়ে উল্লেখপূর্বক বলেন, ‘স্তন ক্যান্সারের চারটি ধাপ নির্ধারণ করে চিকিত্সা কর্ম করতে হয়। প্রথম ধাপে চিহ্নিত হলে হলে সর্ম্পূণ নিরাময় সম্ভব। আর অন্য স্তরগুলোতে পর্যায়ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থা থাকে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনোভাবে নিরাময় করা সম্ভব হয় না। টিনএজদের স্তন ক্যান্সার রোগীদের চিকিত্সা দু’ভাবে করা হয়। প্রথমে ক্যামোথেরাপি দিয়ে চাকাটি হ্রাস করে অস্ত্রোপচার করা হয়। এতে করে রোগী ক্যান্সারের প্রার্দুভাবের কবল থেকে মুক্ত হয়। পরে প্রয়োজনবোধে রেডিওথেরাপি প্রদান করা হয়। তবে বলাবাহুল্য রোগী তার স্তনে চাকার উপস্থিতি টের পেলেও অভিভাবকদের জানাতে বিলম্ব করে ফেলে। আর অভিভাবকরা চিকিত্সকের নিকট শরণাপন্ন হতে দেরি করে ফেলে। ফলে বেশির ভাগ সময়ে অভিভাবকরা দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত বিলম্ব ঘটিয়ে ফেলে। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত অনেক নারী আবার হোমিওপ্যাথি চিকিত্সকের দ্বারস্থ হন। এতে ঝুঁকিমাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়।’