ইয়াবার কুফল ও প্রতিকারের উপায়

দীর্ঘদিন ‘ইয়াবা’ সেবনে শারীরিক ও মানসিক মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। এর মরণ ছোবলে জীবন নিঃশেষ হয়ে যায়। তবে ইচ্ছা করলে এ নেশা থেকে দূরে থাকা যায়। আসক্তরাও চাইলে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ জীবন লাভ করতে পারেন। পরামর্শ দিয়েছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি ও ড্রাগ রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আহসানুল হাবিব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের সজাগ রাখতে এবং দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করতে অ্যামফেটামিনের ব্যবহার শুরু করেন হিটলার। হিটলারের নির্দেশে তখন কেমিস্টরা যে ড্রাগ তৈরি করেন, তার নাম ছিল ‘পারভিটিন’। তবে রূপ বদলে এশিয়ায় ইয়াবার প্রবর্তন করে জার্মানি। শোনা যায়, পাহাড়ে কোনো গাড়ি সহজে টানতে চাইত না বলে ঘোড়াকে পাগল করে দিতে মিয়ানমারের শান প্রদেশে বার্মিজরা এই ড্রাগ তৈরি করে ঘোড়াকে খাওয়াত। পরে প্রচণ্ড কায়িক শ্রমে জড়িত মানুষও এই ঘোড়ার ট্যাবলেট নেওয়া শুরু করে। পর্যায়ক্রমে এটি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের যৌনকর্মীরা সেবন করতে শুরু করে। এখন এই মরণ নেশা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে।

যেভাবে তৈরি হয়
মূলত মেথঅ্যামফেটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি হয় ‘ইয়াবা’। আগে ওষুধ তৈরিতে অ্যামফেটামিন ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে যে ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হয়, তাতে মেশানো হয় হাইড্রোক্লোরিক এসিড, এসিটোন (নেইলপলিশ রিমুভার), রেড ফসফরাস, ব্যাটারির লিথিয়াম, সালফিউরিক এসিড ইত্যাদি। কখনো কখনো এর সঙ্গে হেরোইন মেশানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট আকারে তৈরি হয়। কিছু ক্ষেত্রে ইনজেকশন ও ধাতব ফয়েলে পুড়িয়ে ধোঁয়া হিসেবেও এটি সেবন করা হয়।

ইয়াবা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন—নাজি, স্পিড, হিটলার্স ড্রাগ, সাবু, বুলবুলিয়া, চকোলি, আইস, ক্রিস্টাল, স্পিড, মেথ ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে আসা ইয়াবায় ক্যাফেইনের পরিমাণ খুব বেশি থাকে বলে জানা গেছে।

তরুণ-তরুণীদের কাছে ইয়াবা আকর্ষণীয় করে তুলতে এর মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার; সবুজ বা লাল-কমলা রং। ইয়াবা নামের ছোট্ট এ ট্যাবলেট দেখতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো, স্বাদও তেমনই। ফলে আসক্তরা এর প্রচণ্ড ক্ষতিকর প্রভাবটুকু প্রথমে বুঝতে পারে না।

ইয়াবায় কুফল
ইয়াবার মতো মারাত্মক ক্ষতিকারক মাদক দীর্ঘদিন গ্রহণ করার কারণে দ্রুতগতিতে মানুষের জীবনধারার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়া এই আসক্তির কারণে শারীরিক ও মানসিক—দুই ধরনের মারাত্মক ক্ষতিও হয়।

শারীরিক সমস্যা
যৌন চাহিদার পরিবর্তন : প্রচণ্ড যৌন উত্তেজক ক্ষমতা রয়েছে বলে অনেকে ইয়াবা ব্যবহার করে। আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে এটি ছেড়ে দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইয়াবা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। ইয়াবা গ্রহণের শুরুর দিকে সাময়িক যৌন উত্তেজনা বাড়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে যৌনক্ষমতা লোপ পায় বা একেবারেই ধ্বংস হয়। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার সক্ষমতাও বিনষ্ট হয়। নারীদেরও ঋতুস্রাবে সমস্যা হয় এবং ক্রমান্বয়ে তাদের যৌন চাহিদা, দক্ষতা বা সেক্স পাওয়ার কমতে শুরু করে।

মস্তিষ্কের সমস্যা : মেথঅ্যামফেটামিন ও ক্যাফেইন দুটিই মস্তিষ্কের উত্তেজক পদার্থ, যা সেবনকারীকে বেপরোয়া করে দেয়। ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্কের কিছু ছোট রক্তনালি নষ্ট হতে পারে। দীর্ঘদিন সেবনে অল্প বয়সেও ব্রেনস্ট্রোক করে প্যারালাইজড হওয়া বা চলাচলে অক্ষম হওয়ার আশঙ্কা ৯৫ শতাংশ।

রক্তচাপ বেড়ে যায় : দ্রুত হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ জাগিয়ে তোলে।

মাথা ব্যথা : তীব্র মাথা ব্যথা হয় বা মাথা ধরে।

দৃষ্টিশক্তি কমে যায় : চোখের মণি প্রসারিত (ডায়ালাইটেড) হয়। দৃষ্টি আস্তে আস্তে কমে যায় বা নষ্ট হয়।

স্মৃতিশক্তি নষ্ট : কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না বা ভুলে যায়। কাজের প্রতি মনোযোগ কমে যায় বা আগ্রহ থাকে না।

ক্ষুধা নষ্ট : ইয়াবার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হলো ক্ষুধা কমে যাওয়া বা ক্ষুধাহীনতা। ফলে আস্তে আস্তে ওজন কমে যায়।

বুক ধড়ফড় : মাঝেমধ্যেই বুক ধড়ফড় করে, অস্থিরতায় ভোগে। বুকে ব্যথা বা হার্টের সমস্যা তৈরি হতে পারে।

লিভার সমস্যা : লিভারসিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সারেও পরিণত হতে পারে।

কিডনির সমস্যা : শরীরে এক ধরনের তাপ তৈরি হয়, যা কিডনির ক্ষতি করতে পারে।

ফুসফুসের সমস্যা : নাক দিয়ে ধোঁয়া হিসেবে ব্যবহার করায় ফুসফুসে পানি জমা বা অন্য ক্ষতি হতে পারে।

চর্মরোগ : স্কিন বা চামড়া লাল হয়ে যায় বা মারাত্মক চর্মরোগের সমস্যা তৈরি করে।

কর্মক্ষমতা হারায় : শরীর প্রচণ্ড অলস হয়ে পড়ে। পড়াশোনা, দৈনন্দিন কাজকর্মে আগ্রহ কমে যায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

হাইপারথার্মিয়া : অতিরিক্ত ইয়াবা গ্রহণ হাইপারথার্মিয়া বা উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রার কারণ হতে পারে।

ঘুমের সমস্যা : এর প্রভাবে কেউ দিনে ঘুমায়, রাতে জেগে থাকে। কেউ কেউ টানা সাত থেকে ১০ দিন জেগে থাকে, আবার একটানা ঘুমায়।

উইথড্রলের প্রভাব : কেউ যদি ইয়াবা হঠাৎ ছেড়ে দিতে চায়, তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়। এ জন্য মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেওয়াই ভালো।

এ ছাড়া পেটে ব্যথা, দাঁত কালো হওয়া, বমি বমি ভাব বা বমি, খিঁচুনি এবং খিঁচুনি থেকে মৃত্যুও হতে পারে।

মানসিক সমস্যা
ব্যবহার পরিবর্তন বা মেজাজ বিগড়ে যাওয়া : ইয়াবা আসক্তির ফলে ব্যক্তির ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন ঘটে। মেজাজ বেশ খিটখিটে হয়। আচরণ হয় নিষ্ঠুর, নির্মম ও হিংস্র ধরনের। অল্পতেই অতিরিক্ত রেগে যায়। বিনা কারণে বেশি কথা বলা শুরু করে। অর্থের জন্য মিথ্যা কথা বলা, এমনকি চুরি করাও শুরু করে।

একাকিত্বে ভোগা : সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়। সে সর্বদা মানুষের কাছ থেকে এমনকি অভিভাবকদের থেকেও দূরে থাকার চেষ্টা করে। একেবারে চুপচাপ স্বভাবের হয়ে যায়।

সন্দেহবাতিকতা : অহেতুক সন্দেহবাতিকতা দেখা দেয়। স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা বা অন্যরা তার ক্ষতি করছে—এমন ধারণা পোষণ করে।

নেশায় বুঁদ হওয়া : কখন আবার ইয়াবা নেবে, সে চিন্তায় ঘুরপাক খায়, বুঁদ হয়ে থাকে।

সিজোফ্রেনিয়া ও হ্যালুসিনেশন : কারো ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল হয়ে যায়। চোখে উল্টাপাল্টা দেখে। কারো কারো ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশন বা গায়েবি আওয়াজ শোনার ঘটনা ঘটে।

বিষণ্নতা : বাইপোলার ডিজিজ বা বিষণ্নতা রোগে ভোগে। স্বপ্ন দেখা শুরু করে, দুশ্চিন্তা তৈরি হয়।

আত্মহত্যার প্রবণতা : ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত নানা রকম অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। অনেকে হঠাৎ আত্মহত্যা করে বসে।

চিকিৎসা
ইয়াবা আসক্তদের চিকিৎসা কয়েক ধাপে করা হয়। প্রথম ধাপ হলো ডিটক্সিফিকেশন প্রসেস। এর জন্য মাদক নিরাময়কেন্দ্রে রোগীকে ভর্তি করাতে হয়। সেখানে ইয়াবা গ্রহণ থেকে ব্যক্তিটিকে বিরত রেখে শরীর নেশামুক্ত করা হয়। তখন তার উইথড্রল ইফেক্ট হয়। অর্থাৎ ইয়াবা না-পাওয়ার ফলে তার শারীরিক ও মানসিক কিছু অসুবিধা তৈরি হয়। অবশ্য এ ইফেক্টগুলো ৭২ বা ৯৬ ঘণ্টা পর আর থাকে না। সমস্যাগুলো কতটুকু জটিল হবে, তা নির্ভর করে আগে ইয়াবা গ্রহণের মাত্রা ও পদ্ধতির ওপর। ঘুমের ও আরো কিছু ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।

এক থেকে দুই সপ্তাহ পর শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া দূর হয়। কিন্তু ছয় থেকে আট সপ্তাহ কোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি থাকা ভালো। নচেৎ আবারও সেবনের ইচ্ছা জাগে।
ইয়াবা আসক্তির সঙ্গে শারীরিক বা মানসিক অন্য সমস্যা থাকলে—একই সঙ্গে তারও চিকিৎসা করাতে হয়।
দুই থেকে তিন মাস সময় কোনো নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিলে ইয়াবার কারণে হওয়া অন্য রোগগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তবে চিকিৎসাকালীন বা পরবর্তী সময় আবার আসক্ত হওয়া যাবে না।
চিকিৎসার পাশাপাশি ভর্তির সময় গ্রুপ সাইকোথেরাপি ও ফ্যামিলি থেরাপিও দেওয়া হয়। বাসায় যাওয়ার পরও ১৫ দিন পরে এসে কমপক্ষে ছয় মাস এই থেরাপিগুলো নিলে ভালো। এতে তার আসক্তি কমে যায়।
ইউরিন পরীক্ষা করে জানা সম্ভব, সে আবার এটি নিচ্ছে কি না।

প্রতিরোধে করণীয়

ইয়াবা খেলে যৌন সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়—এমন ভ্রান্ত ধারণা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা।
ইয়াবার অন্যান্য সাইড ইফেক্টগুলো জেনে পুরোপুরি তা এড়িয়ে চলা।
জীবনের প্রতি আগ্রহ বাড়ানো। যেকোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের কৌতূহল কমানো।
নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন শক্ত করা।
আবেগের প্রভাব মানুষকে নেশার দিকে নিয়ে যায়। তাই নিজের আবেগ দমনের ক্ষমতা বাড়ানো।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন নয়। কেউ আসক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা করানো।
যাদের সংস্পর্শে এই পরিণতি, তাদের পুরোপুরি এড়িয়ে চলা। প্রয়োজনে যোগাযোগ বন্ধ করতে ইয়াবা বিক্রেতা, ওই সব বন্ধু-বান্ধবের ফোন নম্বর ডিলিট ও ব্লক করা। প্রয়োজনে নিজের নম্বরও পরিবর্তন করা।
দীর্ঘমেয়াদি হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেওয়া অ্যান্টিডিপ্রেশন, ভিটামিন, ঘুমের ওষুধ ধৈর্য ধরে নিয়মিত সেবন করা এবং মনে যথেষ্ট জোর রেখে চিকিৎসা নেওয়া।
নিয়মিত সুষম ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ।
বাসায় কখনো একা একা না থাকা।
মন ভালো হয়ে যায় এমন কাজ করা, মুভি দেখা, পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দর স্থানে ভ্রমণ করা।
ইয়াবার আগ্রাসন থেকে দেশের যুবসমাজকে রক্ষা করতে সামগ্রিক সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
যেসব পথে দেশে ইয়াবা ঢুকছে, তা বন্ধ করাসহ দেশের ভেতর ইয়াবা উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।
মাদক কারবারিদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
ইয়াবার কুফল সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে বিশেষত উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।