প্রযুক্তি যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যস্ততা। জীবন মানেই এখন এক অন্তহীন মাঠে দৌড় প্রতিযোগিতা, টিকে থাকার এক কঠিন লড়াই। সংগ্রামময় জীবনে টিকে থাকার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে একদিন হুট করেই পৃথিবী থেকে চলে যাই আমরা। জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে আমরা কতভাবে সময় পার করি, কতকিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি, কখনো পড়াশুনা নিয়ে, কখনো চাকরি নিয়ে, কখনোবা সামাজিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে। এতকিছুর ভিড়ে নিজেকে দেওয়ার মতো সময় আমাদের প্রায় কারোই হয়ে ওঠে না। অথচ আমরা নিজেরাই তো আমাদের সবচেয়ে আপন তাই না? তাহলে কেন নিজেদের প্রতি এই অবহেলা? একবার ভেবে দেখুন তো, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন কিছু সময়ের জন্য হলেও শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন, শুধু নিজেকে সময় দিয়েছেন? অধিকাংশ মানুষের উত্তর হবে—না। প্রকৃতি যেমন তার ওপর বিরূপ আচরণ করার জন্য প্রতিশোধ নেয়, আমাদের শরীরও অবহেলা সহ্য করতে করতে একসময় চরম প্রতিশোধ নেয়। নিজেকে সময় না দিলে শরীর মন দু’টোর ওপরই খুব খারাপ প্রভাব পড়ে।
Jim Rohn বলেছেন- Take care of your body. It’s the only place you have to live.
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আপনার শরীরটাই আপনার বেঁচে থাকার একমাত্র উত্স? নাহ ভাবেননি। এত ব্যস্ততার ভেতর এত গভীরে ভাবার সময় কই! কিন্তু একদিন এই শরীরটাই যখন আপনাকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবে, তখন ঠিকই সচেতন হবেন, নিজেকে নিয়ে ভাববেন; দুঃখজনক হলেও সত্যি তখন ভেবে আর কোনো কাজ হবে না। গবেষণা করে জানা গেছে, যারা হার্ট অ্যাট্যাক কিংবা ব্রেইন স্ট্রোকে মারা যায়, তাদের বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত ব্যস্ততা আর মানসিক চাপ। যার ফলে, মানুষ যেকোনো সময় যেকোনো বয়সে মারা যেতে পারে। বিগত কয়েক বছরে এভাবে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিল তুলনামূলক কম, কেবল তারা ব্যস্ততা আর মানসিক চাপের শিকার হয়েছেন, যার পরিণতি অকাল মৃত্যু! এছাড়াও শরীরের আরো অনেক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে শুধু সচেতনতার অভাবে। এটাতো গেল শারীরিক দিক। মানসিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় ব্যস্ততার কারণে।
চাপ সামলাতে না পেরে অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। ব্যস্ততার সময় কাটাতে কাটাতে জীবন একঘেয়ে হয়ে পড়ে, বৈচিত্র্যহীন মনে হয় সবকিছু। মাঝেমাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সবাই সুখী আমি ছাড়া। আর ব্যস্ততা এমনি একটা জাল, যেখানে একবার আটকা পড়লে, সে জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। আর তখন আমরা চিত্কার করে বলি- Stop the world, I want to get off! কিন্তু এভাবে কি সমস্যার সমাধান হয়? হয় না, কখনোই না। ব্যস্ততা আর মানসিক চাপ যেন কখনো আত্মহত্যার কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আর তার জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হচ্ছে নিজেকে সময় দেওয়া। প্রতিদিন সকালে অন্তত গোটা কয়েক মিনিট চা খেতে খেতে নীরবে নিজেকে নিয়ে ভাবুন। দেখবেন, অনেকটা রিফ্রেশমেন্ট নিয়ে দিনটা শুরু করতে পারবেন, নিজেকেও হালকা লাগবে। এভাবে প্রতিদিন সকালে একবার নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করুন। সপ্তাহে অন্তত একটা দিন বা একটা বিকেল নিজেকে আলাদা করে সময় দিন, যে সময়টুকুতে কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকবে না।
আর্থিক চিন্তা থাকবে না, ক্যারিয়ারের চিন্তা থাকবে না, লাভ-লোকসানের চিন্তা থাকবে না; একদম মুক্ত মনে ঘুরে বেড়ান সেই সময়টুকু। জীবনে টিকে থাকতে গেলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, সে চিন্তাগুলো যেন আপনার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য গ্রাস না করে, নির্ঘুম রাতের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। মনোজগতে আলাদা একটা জানালা তৈরি করুন। যে জানালা দিয়ে সমস্ত চিন্তাগুলোকে দখিন হাওয়ার মতো বের করে দিতে পারবেন। তাহলে দেখবেন, কতোটা স্বস্তি নিয়ে বাঁচা যায়।
Lisa Pisha বলেছেন-
Loving ourselves is the process of becoming aware of, and honoring our story, what we like, need, want, believe, crave, how we love, how we think, lea and what fills us up…
নিজেকে সময় দেওয়ার এবং নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো রাখার অন্যতম একটা উপায় হচ্ছে, নিজের যা ভালো লাগবে তা করা। যেমন, কারো ঘুরতে ভালো লাগে। সে মাঝেমাঝে ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে ঘুরে আসতে পারে দূরে কোথাও, যেতে পারে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি।
এতে করে তার শরীরের প্রতিটা কোষে আনন্দ আর ভালোলাগার অনুরণন হবে, যা অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয়ের সহায়ক। আর এই শক্তিকে পুঁজি করেই নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়া যায়, বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় ভালো থাকার আরো অনেকগুলো দিন। কেউ কেউ মুভি দেখতে ভালোবাসে, ছবি আঁকতে ভালোবাসে, একা একা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে ভালোবাসে। প্রত্যেকের ভালোলাগার ওপর কেন্দ্র করে নিজেকে কিছুটা অবসর সময় দেওয়া উচিত। খুব গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত, আমার আসলে কী চাই, কেন চাই, কী পেলে আমার আত্মতৃপ্তিবোধ হবে। আরো খেয়াল রাখতে হবে, আমার চাওয়াগুলো অন্য কারো ক্ষতির কারণ হবে না তো? এভাবে নিজের বোধোদয় জাগ্রত করে, নিজের চাওয়াগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সর্বোচ্চ চাহিদা মেটাতে হবে, অন্তত নিজেকে ভালো রাখার জন্য।
এক জীবনে অনেক বছর বেঁচে থেকেও নিজেকে চেনা হয়ে ওঠে না। খুব কম সংখ্যক মানুষই প্রকৃত অর্থে নিজেকে চিনতে পারে। এর একমাত্র কারণ নিজেকে সময় না দেওয়া। নিজেকে সময় না দিলে, কিভাবে বুঝবেন আপনার কি চাই, আপনি কেমন ধরনের মানুষ কিংবা আপনার ভেতর মুখোশের আড়ালে অন্য কোনো রূপ লুকিয়ে আছে কিনা!
নিজেকে না চিনে, না জেনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে; ভাবতেই খুব আফসোস হচ্ছে না? মানবজনম কি আর বারবার আসে। এই এক জীবনে যদি নিজেকে চিনতে না পারেন, আর কোনোদিন চেনার সুযোগ হবে না। এই আফসোসটা যাতে কোনোদিন না হয়, সেজন্য অনেক ব্যস্ততার ভিড়েও নিজের জন্য খুব যত্নে একটু সময় বের করুন। দেখবেন বেঁচে থাকা মানেই সংগ্রাম নয়, ভালো থাকাও বেঁচে থাকার একটা অনেক বড় অংশ।
আর নিজেকে কখনো কারো সঙ্গে তুলনা করবেন না। আপনি যে শ্রেণির জীবনই-যাপন করুন না কেন, সবসময়ই ভাববেন আপনার জগতে আপনিই রাজা/রাণী। নিজেকে আগাগোড়া ব্যর্থ মানুষ ভাবার কোনো কারণ নেই। নিজেকে সময় দিন, দেখবেন সফলতার পেছনে দৌড়ানোই জীবন নয়; একটা বিকেল নিজের মতো করে কাটানোও জীবন। তখন আর ব্যর্থতাগুলো আপনাকে গ্রাস করবে না।
সবশেষে বলব- নিজেকে ভালোবাসুন, নিজেকে সময় দিন, সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করুন; অন্তত এই যান্ত্রিকতার যুগে নিজেকে ভালো রাখতে চাইলে, নিজেকে সময় দেওয়া খুব বেশি প্রয়োজন।