পার্বত্যাঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার ‘বাঁশ কোড়ল’। মারমারা একে বলে ‘মহ্ই’ আর ত্রিপুরাদের কাছে ‘মেওয়া’। চাকমা ভাষায় বলা হয় ‘বাচ্ছুরি’। মূলত বাঁশের গোঁড়ার কচি নরম অংশকে বলা হয় বাঁশ কোড়ল। পাহাড়ের প্রায় সব স্থানেই মেলে এ সবজি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি এটি এখন বাঙালিদেরও জনপ্রিয় একটি খাবারে পরিণত হয়েছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমে বাঁশ বাগানে জন্ম নেয় নতুন নতুন কোড়ল।
এসব বাঁশে পরিণত হওয়ার আগেই প্রতিদিন বাজারে বিক্রি হয় দেদার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি বাঙালিরাও এখন বাঁশ কোড়ল খেতে শুরু করেছে। ফলে দিন দিন বাঁশ উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এহারে গত কয়েক বছরে পাহাড়ি উপজেলায় প্রায় কোটিরও বেশি বাঁশ অংকুরেই ঝরে পড়েছে বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা।
সচেতন মহল জানিয়েছেন, বাঁশ কোড়ল নিধন অব্যাহত থাকলে আগামি কয়েক বছরের মধ্যেই এতদ্বঞ্চল থেকে বাঁশ সম্পদ একেবারেই হারিয়ে যাবে। সংকট দেখা দিবে দেশের কাগজ শিল্পগুলোতে। তারা দ্রুত বাঁশ কোড়ল নিধন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহনের জোর দাবি জানান।
জানা গেছে, বছরের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এ সবজির ভরা মৌসুম থাকে। মুলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, কালিছুরি বাঁশসহ বেশ কয়েক প্রজাতির বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায়। বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির পানিতে মাটি নরম হলে এটি বাড়তে শুরু করে। মাটি হতে ৪-৫ ইঞ্চি গজিয়ে উঠলে এটি খাওয়ার উপযোগী হয়। বিভিন্ন জাতের বাঁশ কোড়ল স্বাদে ভিন্ন। তবে মুলি বাঁশ কোড়ল সবচেয়ে সুস্বাদু হওয়ায় সবার কাছে এটি জনপ্রিয়। ফলে বাজারে এর চাহিদা ও দাম কিছুটা বেশি। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন সকাল বিকেল জেলা ও উপজেলা শহরের মার্মা বাজারে বাঁশ কোড়ল নিয়ে যান স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা। আর এ কোড়ল কিনতে সব জাতি-গোষ্ঠীর ক্রেতারা অপেক্ষায় থাকেন। প্রতি কেজি বাঁশ কোড়ল পাওয়া যায় ৮০-১০০ টাকার মধ্যে।
তবে চাহিদা অনুযায়ী এর দাম কম-বেশি হয়ে থাকে। বর্তমানে পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে স্থানীয় হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলোতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এ সবজি। পার্বত্যাঞ্চলে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদেরও এখন অন্যতম আকর্ষণ এটি। এছাড়া এ সবজি বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি পল্লীর বহু মানুষ। প্রায় প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় থ্রুং (বিশেষ ঝুড়ি) বেঁধে বাজারে আনা বাঁশ কোড়লের পসরা সাজিয়ে বসেন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা।
বান্দরবান সদরের ছাইংগ্যা, ডলুপাড়া, বাঘমারা, হানসামা পাড়া, তালুকদার পাড়া থেকে আসা বিক্রেতা শান্তি রাণী চাকমা, রত্না তঞ্চঙ্গ্যা, প্রভাতি তঞ্চঙ্গ্যাসহ কয়েকজন আদিবাসী ব্যবসায়ী জানান, তারা প্রতি হাটবারে প্রায় ২০০ আঁটি বাঁশ কোড়ল বাজারে আনেন। প্রতি আঁটি ৮০-১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কথা হয় লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নের উওয়াংচিং মার্মানির সাথে।
তিনি বলেন, বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন, সংসার চালানোর তাগিদে। তার মতো আরও অনেকে সাপ্তাহিক দু’দিন হাট-বাজার ছাড়াও প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে বাঁশকোড়ল বিক্রি করেন বাজারে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের পাশাপাশি বাঙালিদের কাছেও এ সবজি বেশ জনপ্রিয়।
স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে কয়েক প্রজাতির মূল্যবান বাঁশ জন্মায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডলু, কাতি, মিতিঙ্গা, মুলি, কালী ও ছোটিয়া। মূলত বছরের জুন-আগস্ট মাসে বর্ষা মৌসুমে বাঁশের বংশ বৃদ্ধি হয়। এ সময় পাহাড়ের গায়ে মাটি ভেদ করে উঠতে শুরু করলে পাহাড়িরা তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন। এছাড়া পাহাড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক কারণেও বাঁশবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বাঁশ কোড়ল এখন অপ্রতুল। সরকারিভাবে বাঁশবন সংরক্ষণ করা না গেলে একসময় পার্বত্যাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাবে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ, সেইসঙ্গে বাঁশ কোড়ল। রাশেদা বেগম, উষা মার্মাসহ বেশ কয়েকজন গৃহিনী জানায়, স্যুপ, মুন্ডি, মাংস দিয়ে রান্না ও ভাজি করে খাওয়া যায় বাঁশ কোড়ল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত চার বছর আগে পার্বত্য জেলায় বাঁশে ফুল আসে ও মড়ক সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি ইঁদুর বন্যা দেখা দেয়। ফলে একদিকে বাঁশ বাগানে মড়ক অন্যদিকে ইঁদুরও বাঁশ বাগান নষ্ট করে ফেলে। এতেও বাঁশের উৎপাদন কমে যায়। প্রাকৃতিকভাবে বাঁশে মড়ক লাগার দু’বছরের মধ্যে আবার বাঁশের উৎপাদন শুরু হয়। গত বছর প্রতি হাজার মুলি বাঁশের দাম ছিল ১০-১১ হাজার টাকা। এরপরও অনেক পাহাড়ি পরিবার ঘর মেরামত ও নতুন ঘর তৈরি করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে বলে জানিয়েছেন, উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের হ্লাচাই পাড়া কারবারী ধুংচিং অং মারমাসহ আরো অনেকে।
বেসরকারি এক জরিপ মতে, পার্বত্য বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য ধরলে পরিবারের সংখ্যা ৪০ হাজার। প্রতিটি পরিবার সপ্তাহে একবেলা খাবারের সময় ১১টি বাঁশ কোড়ল খেলে এক মাসে এক একটি পরিবার ৪৪টি বাঁশ কোড়ল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। সে হিসেবে তিন মাস বাঁশ জন্মানোর মৌসুমে ৪০ হাজার পরিবার অর্ধকোটির বেশি বাঁশকোড়ল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। এতে ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে বাঁশ সম্পদ।
এ বিষয়ে লামা বিভাগীয় বন কর্মকর্ত মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে বাঁশ জন্মানোর মৌসুম। এ সময় বাঁশ কোড়ল সংগ্রহের ফলে বাঁশ উৎপাদন কমে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে বন বিভাগের রিজার্ভ এলাকা থেকে কাউকে বাঁশ কোড়ল সংগ্রহ করতে দেয়া হয় না।