অভ্যস্ত জীবন, অভ্যস্ত মানুষ। প্রতিদিন একই চক্রে গণ্ডিবদ্ধ চলাফেরা। প্রতিদিন ১০টা-৫টা অফিস। অফিস শেষে বাসায় ফেরা, বউ বা সংসারের অন্য সব প্রিয় মানুষের সঙ্গে আলাপসালাপ। সব মিলিয়ে ‘এই বেশ ভালো আছি’র জীবন। হ্যাঁ, এই ভালো থাকার জীবনে আমার সঙ্গীর সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই আমি সুখী। এখন যেমন বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুমে আমরা দুজন মিলে প্রতি রাতে প্রিয় দলের খেলা দেখি, আমি আর্জেন্টিনা এবং আমার বউ জার্মানির সমর্থক হওয়ায় আজকাল আমাদের মধ্যে যে কিঞ্চিৎ মধুর উত্তেজনা হয় না তা নয়। সেদিনের ঘটনাটিই বলা যাক। জার্মানি বনাম সুইডেনের ম্যাচে টনি ক্রুসের অনবদ্য গোলে যখন জিতে গেল জার্মানি, অম্লমধুর খুনসুটি হলো বউয়ের সঙ্গে। এরপরই নিজের দলের জয়ের আনন্দে মধ্যরাতে নির্মলেন্দু গুণের ‘ক্যান্টনে নিরিবিলি’ নামের কবিতাটি পড়তে শুরু করল আমার বউ:
এইখানে এলে মনে হয় তুমি
সবচেয়ে বেশি নেই।
তোমাকে ক্ষণিক পাবার জন্য
এখানেই তবু আসি,
মুগ্ধ পরান যতদূর চায়
ততদূর ভালোবাসি।
সে রাতে স্ত্রীর কণ্ঠে কবিতা শুনতে শুনতে কেমন যেন উদাস হয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতর গোপনে বেজেছিল কার কথা? পুরোনো সেই তার কথা।
আমার স্ত্রী বর্তমানে আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তাঁর প্রতি আমি বিশ্বস্তও শতভাগ। তবু বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে কাতরতা জাগিয়ে কেন মনে হয় ‘তুমি সবচেয়ে বেশি নেই’। কারণ, আমার বর্তমানের এই সুখী জীবনের ভেতরে অতীতকাল এবং অতীতের সঙ্গীর স্মৃতিঘেরা আরেক ‘পলাতক জীবন’ আছে, কোনো এক ঘোরে, চকিত মুহূর্তে এই জীবনের মধ্যে সেই জীবন হানা দেয় কখনো-সখনো।
কেবল আমার ভেতরে নয়, আপনার মধ্যেও আছে সাবেক সম্পর্কের স্মৃতিবাহী ‘পলাতক জীবন’। ধরা যাক, আমার মতো আপনিও আপনার বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে ভীষণ সুখী। কিন্তু আপনি কি হলফ করে বলতে পারেন, আপনার পুরোনো প্রেমিক বা প্রেমিকা অথবা সাবেক সঙ্গীর কথা আপনার কখনো মনেই পড়ে না? হয়তো কোনো এক পরিস্থিতিতে আপনি তাকে ছেড়ে এসেছিলেন, হতে পারে তিনিই ছেড়ে গিয়েছিলেন আপনাকে। তারপর থেকে আপনাদের ভেতরে যৌথ লেনদেন চুকেবুকে গেলেও এবং সম্পর্কটি যদি খুব তিক্ততার মাধ্যমে শেষ না হয় তবে ‘মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে / যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না’র মতো করে হলেও তাকে—আপনার সেই পুরোনোকে মনে পড়বে। কেননা, স্মৃতি তো আর মুছে ফেলা যায় না। আর কে না জানে, একজীবনে একই ধরনের ঘটনা অনেকবারই ঘটতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ ভিন্ন হয়ে যায় হয়তো।
না, নিজের গল্প আর নয়। চেনাজানা দু-একজন দম্পতির জীবনের গল্প বলি বরং। এখানে পাত্রপাত্রীর নাম-পরিচয় বদলে দেওয়া হলেও ঘটনাগুলো কিন্তু শতভাগ সত্য:
মিশু খুব আলুভর্তা দিয়ে ঘি-ভাত খেতে চাইছে। সাধারণত ঘি সে খায় না। আজ চাইছে। রান্নাঘরে সেদ্ধ আলু ছিলতে ছিলতে মোনার হাতে খানিকটা আঁচ লাগল। আলু সেদ্ধ দিয়ে ঘি-ভাত ভীষণ পছন্দ করত পাভেল। পাভেল মোনার সাবেক স্বামী। শ্বশুরবাড়ি ও বাপের বাড়ি—এই দুই পরিবারের মধ্য বনিবনা না হওয়ায় পাভেলের সংসার ছাড়তে হয়েছিল মোনাকে। তখন তার সহায় ছিল মিশু। তাকে আঁকড়ে ধরেই মোনার আবার নতুন করে বাঁচা। এখন মিশুর সংসারে সে সুখীও বটে, তবু কোনো কোনো পল–মুহূর্তে কেন যেন এখনো মোনার মনে হয়, পাভেলকে একটু ঘি-ভাত করে দিতে পারলে খুব খারাপ লাগত না!
মিশু-মোনা-পাভেলের গল্প থেকে বেরিয়ে চলুন এবার ঢুকে পড়ি আতিফ-পিয়া ও মঞ্জুরের গল্পে:
পিয়া এক ছেলের মা। তার স্বামী আতিফ ব্যাংকার। আতিফের সঙ্গে বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত মঞ্জুরের জন্য কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছিল পিয়া। তাঁর পরিবার থেকে মেনে নেয়নি এই প্রেম, মঞ্জুরও এগিয়ে আসেনি সাহস করে। ফলে মনের কষ্ট মনে রেখে সংসারি হতে হয়েছে পিয়াকে। আতিফ অবশ্য অযত্ন করেনি পিয়ার। তাঁর ভালোবাসায় খাদও পায়নি পিয়া। কিন্তু আজ এত বছর পরও কোনো ছেলেকে ফুচকা খেতে দেখলে মঞ্জুরের কথা মনে হয় পিয়ার। মঞ্জুর ছিল খুব ফুচকাপ্রেমী, অথচ পিয়া সে সময় মুখেই তুলতে পারত না ফুচকা। পিয়ার এখন মাঝেমধ্যেই মনে হয়, আজকাল সে হরহামেশা ফুচকা খায়, মঞ্জুর এটা জানতে পারলে খুব অবাক হবে তাই না?
বর্তমানকে নিয়ে সুখী হওয়ার পরও ছোট্ট ছোট্ট পুরোনো স্মৃতি দমকা হাওয়ার মতো দোলা দিয়ে যায় আমাদের। এই যে সুখ-শান্তির এক জীবনের মধ্যে পলাতক আরেক জীবন নিয়ে চলা, এটি কি অসততা? নিজের সঙ্গীর প্রতি অবিশ্বস্ততা? প্রশ্ন আসে, দ্বিধা জাগে মনে। মানুষের মনের গলিঘুপচি ঘেঁটে মনোবিজ্ঞান বলে, দৈনন্দিন জীবনের পথচলায় বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের আবেগাশ্রয়ী স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে—এটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই কি এভাবে মনে পড়া, প্রিয় প্রাক্তনদের এভাবে ঘোরের মধ্যে উঁকি দিয়ে যাওয়া? হয়তোবা।
অতীত চলে যায়। তবু থেকে যায় স্মৃতি। স্মৃতির সেই ক্ষত পোড়ায় না বটে তবে হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দেয় পুরোনোকে।
বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া কলকাতার প্রাক্তনচলচ্চিত্রের পুরোটাই তো ধারণ করে আছে প্রেমের পুরোনো দাগ। ছবিতে প্রাক্তন স্বামী উজানকে (প্রসেনজিৎ) মালিনীর (অপরাজিতা আঢ্য) সঙ্গে ‘সুন্দর সংসার’ করতে দেখে আনচান করে উঠেছিল প্রথম স্ত্রী সুদীপার (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) মন। অথচ দেখা যায়, সুদীপাও তখন অন্য আরেকজনের ঘরনি, অন্য কারও ছন্দে বঁাধা গানের মতো।
এ কথা সত্যি যে নানা রকম সামাজিক বিধিনিষেধ আর কড়িবর্গা ডিঙিয়ে বেশির ভাগ সময়ই পুরোনো সম্পর্কের গল্পগুলো উচ্চারণ করা যায় না বর্তমানে। সেটি আমরা করতেও চাই না। কিন্তু মন বড় নচ্ছার, সব সময় সে কি আমাদের নিয়ন্ত্রণ মানে। তাই তো এ ক্ষেত্রেও বাঙালির সহায় ওই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দারুণভাবে বর্তমানে অভ্যস্ত আমাদের বাস্তব জীবনে কোনো নাটকীয়তা না থাকলে রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা হওয়ার ঘটনা সাধারণত ঘটে না। তবু ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার মতো আমাদের মনের অন্দরে আছে এক অদৃশ্য রেলগাড়ির কামরা। সেখানে বসেই আমরা বলি যে, ‘রাতের সব তারাই আছে/ দিনের আলোর গভীরে।