গর্ভে বাচ্চা নিয়েও- রাজধানীর ভাসমান যৌনকর্মী রেশমা। তার পেশা পতিতাবৃত্তি। বিজয় স্মরণী এলাকায় প্রায় প্রতিরাতে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকে মেয়েটি।
খদ্দের পেলেই তার পেটে খাবার পড়বে, দিতে পাড়বে তার মাথার উপর থাকা ছাদের ভাড়া। সে এ অনিশ্চিত জীবন আর টেনে নিতে পাড়ছে না। এবার মুক্তি চায়, সমাজে ভালো একটা পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চায়।
রেশমার ভাষ্য, ‘গর্ভে সন্তান নিয়েও গভীর রাতে এখানে এসেছি। আটমাসের সন্তান গর্ভে থাকার পর খদ্দেরের বিছানায় শুয়েছি। গর্ভবতী হওয়ার পর দুই-তিন মাস বাসায়-ই ছিলাম, কিন্তু আর চলছিলো না। পেটের ক্ষুদায় বাধ্য হয়ে গর্ভবতী অবস্থায়-ই এ কাজ করেছি। কিন্তু সে সন্তানকেই কাছে রাখতে পারলাম না।’
বিজয় স্মরণী এলাকায় বুধবার রাতে দেখা একটি গাছের তলায়। যেখানে খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে আছে রেশমারা। তার পেছনেই কাপড় দিয়ে বানানো রাতের ঘর।
এ গাছ ও গাছে আড়াআড়ি করে কাপড় বেঁধেই ঘর বানায় রেশমারা। গোটা রাস্তাজুড়েই কয়েক হাত পরপর অমন ঘর চোখে পড়ে। ও ঘরেই খদ্দেরকে আনন্দ দেয় রেশমারা।
রেশমা জানায়, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর চোয়াল ভেঙেছে খানিক। শরীরের গাঁথুনিও আর আগের মতো নেই। শুকিয়ে অনেকটাই রোগা রোগা ভাব।
রাস্তার সোডিয়াম বাল্বের আলোর কিরণ গিয়ে পড়ছে ওর মুখজুড়ে। তাতে ফ্যাকাশে জীবন কিছুটা আলোকময় হয়ে উঠছে বটে। আলোতে দেখতে পেয়েই খদ্দেররা ঘেঁষে রেশমাদের কাছে। কোলের ওপর রাখা হাতের কব্জি ভরা কাঁচের চুড়ি। তাতেও আলোর ঝিলিক পড়েছে।
ঘড়ির কাঁটা তখন চারটার কোটা পার করছে। সারারাত খেটে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফুটপাতে বসা। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। তবুও খদ্দেরের আশায় চেয়ে আছে।
রেশমা শোনালো ওর গল্প।
রোজার দুই সপ্তাহ আগে তৃতীয় সন্তান জন্ম দিয়েছিল রেশমা। জন্ম দেয়ার পর একবার সন্তানের চোখে চোখ রাখার সুযোগ পেয়েছিল। এরপর আর খবর জানে না। আগে থেকেই দালাল ঠিক করা ছিল। বুকের দুধও আর খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি। ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে জন্মের পর মুহূর্তেই। এ টাকাতেই রেশমার হিসেব শেষ।
এরপর দালাল কার কাছে, কত টাকায় বিক্রি করেছে তাও জানে না রেশমা। কেন বিক্রি করতে হলো সন্তানকে, এসব জানতে চাইলে গলা ধরে আসছিল ওর।
সিগারেটে ফুঁক দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, পেটের জ্বালায় বিক্রি করেছি। ওরে গর্ভে নিয়ে শেষের দুই মাস আর কাজ করতে পারছিলাম না। বাড়ি ভাড়া বাকি ছিল। দোকানেও বাকি ছিল। ২০ হাজার টাকা ঋণ হওয়ায় চোখে সরষে ফুল দেখছিলাম। উপায় না পেয়েই বিক্রি করেছি।
‘বিক্রিই যদি করতে হয় তাহলে এত কষ্ট করে গর্ভধারণের দরকার কি’ এমনটি জানতে চাইলে রেশমা বলেন, ইচ্ছা ছিল দেশে যাওয়ার। নেশাখোর স্বামীরে ভালো করে ময়মনসিংহ চলে যাব।
অন্য কিছু করব। তা আর হয়নি। স্বামীর কারণেই হয়নি। সে চায় আমি রোজ রোজ সকালে গিয়ে তার হাতে টাকা দিই। শেষে বুঝলাম, এ কাজই করতে হবে। কোলে মাইয়া নিয়া তো রাস্তায় খাড়াতে পারমু না। খদ্দের পামু না। তাই বেচে দিলাম।
মেয়েকে দেখতে মন চায় না? জানতে চাইতেই চোখ ছলছল করে উঠল রেশমার। ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘ওরে গর্ভে নিয়ে সাড়ে সাত মাস রাস্তায় কাজ করেছি। শীতের রাতের কষ্টের কথা মুখে বলা যায় না।
স্বপ্ন ছিল অনেক কষ্ট হলেও আদর-যত্ন করে বড় করব। বড় মেয়ে মিমের সঙ্গে মিলিয়ে নামও রেখেছিলাম। জানিনা ওর নাম কি রাখা হয়েছে। শুনেছি পঙ্গু হাসপাতালের এক ডাক্তার কিনে নিয়েছে। কিন্তু তার ঠিকানা জানি না।’