ঈদে কেমন খাবার চাই

সাধনার পর আসছে ঈদ, যা বয়ে আনবে সকলের জন্য অনাবিল আনন্দ। ছোট বাচ্চা থেকে বয়স্করা সবাই ঈদের আনন্দকে বরণ করে নেয়ার জন্য উদগ্রীব। আর ঈদের দিনে আনন্দের অন্যতম আয়োজনটাই হলো নানা রকমের খাবার দাবার। সকাল বেলা উত্সবের শুরুটাই হয় মিষ্টি, সেমাই, পোলাও, কোর্মা আরো কত রকমের খাবার দিয়ে। রোজার একমাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবন যাপন প্রণালীতে যে পরিবর্তন আসে, সেটাতেই অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এ কারণে হঠাৎ ঈদের দিনে অতিভোজনের ফলে পাকস্থলি তথা পেটের উপর চাপ পড়ে বেশি। নিজের ঘরে হরেক রকমের খাবারের সাথে সাথে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়- স্মজনের বাসায় বেড়াতে গেলেই ইচ্ছা অনিচ্ছায় আরো বেশি খেতে হয়। ফলে অধিক চাপে অনেক সময় পাকস্থলির এনজাইম ঠিকমত কাজ করতে পারে না। এ কারণে পেট ব্যথা, গ্যাস্টাইটিস, ডাইরিয়া, বমি, পেটফাঁঁপা ইত্যাদি হরহামেশাই দেখা যায়। সাধারণত ঈদের দিন প্রচুর তৈলাক্ত খাবার যেমন পেলাও, বিরিয়ানী, মুরগি, খাসী বা গরুর গোসত, কাবাব, রেজালা আর এর সাথে মিষ্টি জাতীয় খাবার আমরা সবাই খাই। এসব খাবার পরিপূর্ণভাবে হজম করতে অন্তত: ১০-১২ ঘন্টা সময় লাগে। একসাথে বেশি খাওয়ার ফলে পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, বারবার ঢেকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। যাদের পেপটিক আলসার আছে তাদের রোজা রাখার ফলে দীর্ঘক্ষণ পেট খালি থাকার জন্য নিঃসরিত হাইড্রোক্লোরিক এসিড পাকস্থলী ও ডিওডেনামে ক্ষত করতে পারে। ঈদের দিন তৈলাক্ত ও ঝাল-মশলাযুক্ত খাবার খাওয়ায় পাকস্থলী ও ডিওডেনামের ক্ষতে পুনরায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফলে বুক জ্বালা, পেট জ্বালা ইত্যাদি অনেক বেড়ে যায়। আইবিএস বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম রোগে যারা ভোগেন, তাদের সমস্যাটা আরো বেশি দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দুগ্ধজাত খাবারগুলো যেমন পায়েস, সেমাই, হালুয়া ইত্যাদি খাবারে অস্বস্থি, ঘন ঘন মলত্যাগ ও অসুম্পর্ণ মলত্যাগের অনুভূতি হয়। আবার বিভিন্ন খাবার অন্ত্র থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে। ফলে কোষ্ঠ-কাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। যাদের অ্যানাল ফিশার ও পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি আগে থেকেই আছে, তাদের এ সমস্যা আরো বেশি প্রকট হয়। যাদের হিমোরয়েড বা পাইলসের সমস্যা আছে, তাদের পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে।

আসলে ছোট বাচ্চাদের ঈদ আনন্দটা সবচেয়ে বেশি। তারা শখ করে দু’একটা রোজা রাখে, রোজা শেষে ঈদের দিন মজার মজার খাবার খেতে বেশি পছন্দ। তবে অতিভোজনে যে কারো মতো ছোটদেরও সমস্যা হতে পারে। যে কোন কিছু্ খেলেই সবসময় শরীরে সমস্যা হবে এমন কথা নেই। শুধু পরিমাণটা ঠিক রাখলেই হলো। কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে হজমে সহায়ক সব ধরণের এনজাইম সঠিকভাবেই কাজ করে। এমনকি গুরুপাক তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাদ্যগুলো সহজে হজম হয়ে যায়। তবে অবশ্যই অতিভোজন না করাই ভালো। ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েস খাওয়া ভালো। এগুলোর সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম, ফলের জুস, যেমন- পেঁপে, আম ইত্যাদি খেতে পারেন। খাবার আধ ঘন্টা পর

দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। দিনে বিভিন্ন ধরণের খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া ভালো। একবারে বেশি করে না খেয়ে অল্প অল্প করে বার বার খাবেন। যারা ঈদের দিন চটপটি জাতীয় খাবার পছন্দ করেন, তারা তেঁতুলের টক মিশিয়ে খেতে পারেন। পোলাও বা বিরিয়ানীর সঙ্গে অবশ্যই সালাদ জাতীয় খাবার এবং দই খেতে পারেন। মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক মানুষের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রয়োজন। এমনকি হাইপারেটেনশন, ডায়াবেটিস, হাইপারকোলেস্টেরমিয়া ইত্যাদি না থাকা সত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। যারা উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ, ডায়াবেটিস রোগে ভোগেন, তারা খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক হবেন। কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম, ইত্যাদি সামান্য খেতে হবে। এমনকি ফলমুলও বেশি খাওয়া যাবে না।

মনে রাখতে হবে
১. অতিরিক্ত পোলাও, বিরিয়ানি বা চর্বি জাতীয় খাবার পরিমিত খাবেন
২. যারা গ্যাস্ট্রিক আলসার বা আইবিএস বা অন্যান্য পেটের রোগে ভোগেন, তারা ডমপেরিডন, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল বা প্যান্ট্রোপ্রাজল জাতীয় ওষুধ খাবেন। এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ এবং বিভিন্ন এনজাইম খেতে পারেন।
৩. যাদের আইবিএস আছে, তারা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করবেন।
৪. রাতে কোনো দাওয়াতে গেলে অল্প পরিমাণে খাবেন। খাওয়ার অন্তত: দু’ঘন্টা পর বিছানায় যাবেন।
৫. ঈদের সময় সাধারণত সবাই একত্রে বসে খায় এবং অনেক গল্প গুজব করেন। এতে অতিরিক্ত বাতাস পাকস্থলীতে ঢুকে, ফলে বার বার ঢেঁকুর তোলার সমস্যা হয়। তাই খাবারের সময় যতটা সম্ভব কম গল্পগুজব করা উচিত এবং খাবার ভালো করে চিবিয়ে খেতে হবে।
৬. খাবারের সময় একটু পর পর পানি না খাওয়া ভালো, এতে হজম রসগুলো পাতলা হয় এবং হজমের অসুবিধা হতে পারে। তাই খাওয়ার অন্তত: আধা বা এক ঘন্টা পর পানি পান করা উচিত।
৭. গুরুপাক জাতীয় খাবার না খাওয়াই ভালো। যদি একান্তেই খেতে হয়, তবে পরিমাণে কম খেতে হবে। যে খাবারে সমস্যা বেশি হয় তা পরিহার করা উচিত। ঈদ অবশ্যই আনন্দের, আর এর সাথে মনে হয় ভুরিভোজ না করলে আনন্দটার পূর্ণতা পায় না। খাওয়া দাওয়ার সাথে মনে রাখতে হবে খাওয়াটা যেন হয় ভেজালমুক্ত, টাটকা, স্বাস্থ্যসম্মত, সহজপ্রাচ্য এবং উপাদেয়। অবশ্যই হতে হবে পরিমিত এবং পরিকল্পিত। অতি ভোজনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তাহলেই শরীরটা এবং মনটাও সুস্থ থাকবে সব সময়। একথাও মনে রাখতে হবে, অতি ভোজন এমনকি স্বাভাবিক খাওয়া দাওয়ার ফলেও যদি শারীরিক সমস্যা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।