ব্যাংক বাঁচাতে আবারও করের টাকা

  • আসছে নতুন বাজেট
  • চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল
  • এবারও প্রায় একই পরিমাণ অর্থ রাখা হচ্ছে
  • বিনিয়োগের নামে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলো যখনই মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে, তখনই তা জনগণের করের টাকায় পূরণ করে আসছে সরকার। এসব ব্যাংকের জন্য আগামী বাজেটেও বরাদ্দ থাকছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য গত ছয় বছরেই সরকার ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকগুলোকে দেওয়ার জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, যদিও তা এখনো ছাড় হয়নি। ছাড় হবে ৭ জুন বাজেট ঘোষণার পর। আর আগামী বাজেটেও ব্যাংকগুলোর জন্য প্রায় একই পরিমাণ অর্থ রাখা হচ্ছে।

জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে যে পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে, সেই পরিমাণ টাকাই সরকারকে দিতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা হচ্ছে উল্লেখযোগ্য।

সচিবালয়ে গতকাল সোমবার এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, ‘ব্যাংকগুলোর জন্য আগামী অর্থবছরেও বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।’ প্রশ্ন করা হলেও বরাদ্দের পরিমাণটি জানাতে চাননি তিনি। তবে আলোচিত-সমালোচিত ব্যাংক খাতের অনিয়ম প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এ বিষয়ে চলতি মাসেই তিনি একটি কমিশন গঠন করবেন।

ব্যাংক খাতের বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির বোঝাও এখন সরকারকে বইতে হচ্ছে। যেমন অনিয়মে ডুবতে থাকা ফারমার্স ব্যাংকের শেয়ার কিনতে হয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, জনতার মতো ব্যাংকগুলোকে। অথচ এসব ব্যাংক নিজেরাই রয়েছে মূলধন ঘাটতিতে।

বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, যেহেতু ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি হওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে এবং সরকার জানে যে আরও অনিয়ম-দুর্নীতি হবে, তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে বাজেটেই টাকা রাখা হচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাতে এ রকম বার্তা রয়েছে যে মূলধন সংকট বা যেকোনো সংকটে পাশে আছে সরকার। এ কারণেই ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার উন্নতির পরিবর্তে উল্টো সরকারের প্রতি নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। সে কারণেই ঋণ দেওয়ায় অনিয়ম হচ্ছে, খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না, ঋণ অবলোপন হচ্ছে এবং সরকারি কোষাগার থেকে ব্যাংকগুলোকে প্রতিবছর টাকা দিতে হচ্ছে। এ খাতের সুশাসনের জন্য সরকারের চেষ্টার ঘাটতি রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিনিয়োগের নামে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন
অর্থ বিভাগের তথ্য-উপাত্ত বলছে, বাজেটে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণ বাবদ বরাদ্দ রাখা শুরু হয় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে। সরকার প্রতিবছর এই খাতে বাজেট বরাদ্দের শিরোনাম দিয়ে থাকে ‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’। যে টাকা ফেরত আসার নূন্যতম সম্ভাবনা নেই, তাকে বিনিয়োগ বলা যায় কি না সেই প্রশ্নও উঠছে এখন।

অর্থ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যা অবশ্য এ রকম, ‘সরকার তার নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অর্থের সরবরাহ করবে। এটা আসলে বিনিয়োগই। প্রশ্ন উঠতে পারে তা ভালো বিনিয়োগ না খারাপ বিনিয়োগ।’

বাজেট প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছয় বছরে কখনো মূলধন ঘাটতি বা কখনো মূলধন পুনর্গঠনের নামে ছয় ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। কাউকে টাকা দেওয়া হয়েছে তহবিল ও ঋণ সহায়তা, আবার কাউকে দেওয়া হয়েছে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির জন্য।

অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৩৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও তা ছাড় করা হয়নি। পরের অর্থের বছর ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও দেওয়া হয় ৫৪১ কোটি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৪২০ কোটি টাকা, কিন্তু ওই ব্যাংকগুলোকে দেয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

পরের বার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকার নিজেই পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে, কিন্তু ওই টাকায়ও কুলোয়নি। ওই বছর ব্যাংকগুলোকে দিতে হয় ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ থেকে চলতি অর্থবছরসহ প্রতিবারই বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে টাকা বরাদ্দ রাখা উচিত নয়। যেহেতু পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছেই, ফলে দেশীয় বাস্তবতা বলে খারাপ পরিস্থিতি সামাল দিতে গেলে টাকা রাখতেই হবে।’ অবশ্য তিনি খেলাপি ঋণ আদায়সহ শর্তপূরণ সাপেক্ষে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেওয়া এবং কঠোরভাবে তা নজরদারি করা উচিত বলে মনে করেন।

মূলধন ঘাটতি বাড়ছেই
বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী সোনালী, জনতা, রূপালী, বেসিক, কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অথচ তার আগের তিন মাস আগে অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরেই এই ঘাটতি ছিল ১৫ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। তিন মাসে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সোনালী ব্যাংকের কারণেই ছয় ব্যাংকের মোট মূলধন ঘাটতি অনেক বেড়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেছে।’

চলতি অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দুই হাজার কোটি টাকা দিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্প্রতি অর্থ বিভাগে সুপারিশ করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, মূলধন ঘাটতি পূরণের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত উপায় হচ্ছে নিট মুনাফা অর্জন করে তা বণ্টনের পরিবর্তে বোনাস শেয়ার ছাড়া। কিন্তু ব্যাংকগুলো তা পারছে না। বিভাগটির মতে, আরেকটি ভালো উপায় হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমিয়ে ঘাটতি কমানো। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সাফল্যই নেই ব্যাংকগুলোর।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর জন্য এবার মূলধন ঘাটতি পূরণের টাকা অর্থ বিভাগ এখনো ছাড় করেনি। বাজেটে যাতে আর বরাদ্দ রাখতে না হয়, এ ব্যাপারে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে।’

গত প্রায় এক দশক ব্যাংক কেলেঙ্কারির দশক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ জন্য কারও কোনো শাস্তি হয়নি। বরং নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পূরণ করা হয়েছে ঋণ খেলাপিদের আবদার। শুধু ঋণখেলাপি নয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিবারতন্ত্রের পথও সুগম করে দিয়েছে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়, ব্যাংক মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশসন অব ব্যাংকসের (বিএবি) কথাতেই নীতি বদলে যাচ্ছে।

এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা বলছেন। তবে আগামী নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্যই শেষ সময়ে এসে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সাবেক ব্যাংকাররা।