ছিঃ গাঁজাখোর!

মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। কিন্তু কোনগুলো মাদক আর কোনগুলো না- সেগুলো নিয়ে কোনো আলাপ হচ্ছে?

মাদক কী আসলে? যা নেশা তৈরি করে- সেগুলো মাদক? নেশা তো অনেক রকম আছে। ফেসবুকে ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রল করে যাওয়া, ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে গল্পগুজব করা- এ-ও তো নেশা। সমাজবিজ্ঞানী-মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা করছেন। কথাবার্তা বলছেন (https://goo.gl/dSrN1p)। টাকা কামানো, ক্ষমতা দখল- এগুলোও নেশারই মতো। এগুলো নিয়ে আলাপ হবে না?

আচ্ছা ওগুলা বাদ। মদ-ভাঙ-গাঁজা-তাড়ি-সিগারেট-ইয়াবা-হেরোইন-কোকেন; এগুলো নিয়েই আলাপ হোক তাহলে।

বঙ্গ অঞ্চলের মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তালের তাড়ি, গাঁজা-ভাঙ, ভাত পঁচানো চোলাই- ইত্যাদি খেয়ে আসছে। এত সামাজিক অবক্ষয়, বিকারগ্রস্থ অবস্থা হয়নি তো কখনো। বরং তালের তাড়ির অনেক উপকারের কথাই শুনেছি বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে তো দেখা যাচ্ছে বজ্রপাত থেকে বাঁচার জন্য বেশি বেশি করে তালের গাছ লাগানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

গাঁজার ক্ষেত্রেও কমবেশি একই কথা প্রযোজ্য। গাঁজার চল চলে আসছে অনাদিকাল থেকে। সেই শিবঠাকুরের সময় থেকে। এখনও এই উপমহাদেশের অনেক জায়গায় গাঁজা খাওয়ার সঙ্গে আধ্যাত্মিক চর্চার একটা যোগ আছে। গাঁজা বৈধ করার দাবিতে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোর আন্দোলন হচ্ছে। কোথাও কোথাও তো সেটা বৈধ করাও হয়েছে।

গাঁজা, তালের তাড়ি, চোলাই- এগুলো নিয়ে কোনো রাখঢাকও ছিল না কখনো। লুকোছাপার কোনো ব্যাপার ছিল না। এগুলোকে কেউ দোষ বলেও মনে করত না। কবে থেকে এগুলোর গায়ে মাদকের ছাপ্পা লাগল? অনুসন্ধান করা দরকার।

সহজ বুদ্ধিতে যেটা বুঝতে পারি তা হলো: যখনই দেখা যায় এগুলো দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না তখনই সেগুলোর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয় এই পুঁজিবাদী সমাজ। কারণ তালের গাছ তো বাড়ির পাশেই হয়। সেটা তো আর দোকান থেকে কিনতে হচ্ছে না। ফলে ব্যবসার সুযোগ কই? গাঁজার ক্ষেত্রেও একই কথা।

এগুলো খেয়ে কেউ শারীরিক অসুস্থতার শিকার হন- এমন কথাও প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। বরং ভালোমতো অনুসন্ধান করলে এগুলোর হাজারো উপকারিতাই বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে।

আচ্ছা… এবার মদ-সিগারেট-হিরোইন-ইয়াবা-কোকেনের প্রসঙ্গে আসা যাক। শুরুতেই এই সব কিছুর মধ্যে একটা মিল চোখে পড়ে। এই সব কিছুই উৎপাদন করার ব্যাপার। পুঁজিপতিদের পুঁজি লগ্নি আর মুনাফা কামোনোর ব্যাপার। কৃত্রিম এই নেশাগুলো এই বাংলার মাটিঘনিষ্ঠও না। বর্হিদেশীয় উৎপাদ-উৎপাত।

হিরোইন-কোকেন-ইয়াবা তো খুব বেশিদিন হয়নি এই বঙ্গ সমাজে আমদানি হয়েছে। ইয়াবা তো আসল সেই সেদিন। মেরেকেটে ১০-১৫ বছর হয়তো হবে খুব বেশি হলে। সেই ইয়াবারই এখন কী রমরমা! ইয়াবাসহ হিরোইন-কোকেন ইত্যাদি প্রভৃতি সব কৃত্রিম, কারখানায় বানানো বিকারগ্রস্থ নেশারই আগমন ইতিহাস খুব অল্প সময়ের মামলা।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, সবগুলোরই আমদানি ঘটেছে কিন্তু বড়লোকদের হাত ধরে। ‘বড় বাপের পোলারা’ ফুর্তি করার জন্য, ‘ডিফারেন্ট কিছু ট্রাই’ করার জন্য এসব শুরু করে। খুব সম্প্রতি ইয়াবার বঙ্গে আবির্ভাবের ইতিহাস ঘাঁটলে তা ভালোমতোই বুঝতে পারা যায়।

থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক অর্থের বিনিময়ে ইয়াবা প্রথমে ঢুকেছিল বড়লোকদের ফুর্তিখানায়। সেখান থেকেই বিস্তার-বিস্তৃতি। আর এখন গ্রামেগঞ্জে ২০০-৩০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যায় ইয়াবার প্যাকেজ। কিভাবে সম্ভব হলো? বিকৃত একটা জিনিশের আরও নানা বিকৃতি ঘটিয়ে, নিম্নমানের কেমিক্যাল মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হলো মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য।

আচ্ছা… এবার সমাজের বৈধ আর উপরিভাগে থাকা বহুল প্রচলিত দুটির নেশার প্রসঙ্গ। সিগারেট আর মদ। এগুলো ক্ষতিকর দিক নিয়ে আর নতুন করে বলার কী আছে। সবাই সব জানি-বুঝি। তারপরও সেগুলো বৈধ কেন? সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা নেই কেন? কারণ সেগুলো বাজারে কেনা-বেচা করা যায়। সেগুলো নিয়ে ব্যবসা করা যায়।

তালের তাড়ি-গাঁজা ছোটলোকের জিনিস বলে সেগুলোর ওপর স্টিমরোলার চালাব! আর মদ-সিগারেট বড়লোকদের জিনিস বলে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে থাকবে!

বারে গিয়ে গলা অব্দি মদ খেয়ে মাতলামো করবো! কোনো সঙ্কোচ হবে না। বরং বুক ফুলিয়ে গল্প করব যে, বোতলটা কোন দেশ থেকে ইনটেক এসেছিল! এক বোতলের দাম কত হাজার টাকা! আর গাঁজা খাবো চিপা-চুপায় গিয়ে! কেউ দেখে ফেললে? প্রেস্টিজ পাংচার। ছিঃ গাঁজাখোর!

আর কতো হিপোক্রেসি করব আমরা?