এখানে প্রতিটি ভোর হয় নতুন কিছুর জানান দিয়ে। এখানে আড্ডার জায়গা মানেই ব্ল্যাক হাউস, রতনপল্লির কালোর দোকান, নবদ্বীপ কিংবা রুদ্রপলাশের মোড়, মেলার মাঠ, কখনোবা খোয়াইয়ের হাট, আর প্রিয় কোপাই নদী তো আছেই। বুধবার হলেই সকাল সকাল সাদা জামা পরে চোখ ঘষতে ঘষতে আমরা চলে যাই কাচ মন্দিরে। গৌড় প্রাঙ্গণে গোধূলি নামে যখন, তখন মনে হয় ভাগ্যিস, এখনো বেঁচে আছি। না হলে এত সুন্দর দৃশ্য তো দেখতেই পেতাম না কোনো দিন।
প্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো এতক্ষণে বুঝেও গেছেন, আমি কী নিয়ে কথা বলছি। শান্তিনিকেতন। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন। আমার প্রিয়, আমাদের প্রিয় শান্তিনিকেতন।
শান্তিনিকেতন নিয়ে লিখলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে। তবে আজ বসেছি শান্তিনিকেতনে তৈরি আমার এক নতুন অহংকার, অনেকটা আবেগ আর ভালোবাসাকে নিয়ে লিখতে।
সেই অনুভূতি, অহংকারের নাম ‘বাংলাদেশ ভবন’। এই নামের সঙ্গে এখন সবাই পরিচিত। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভবন এখন সসম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
শুরুটা কীভাবে হলো বলি। ইন্দিরা গান্ধী সেন্টারে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। চোখে পড়ল, একটা সুন্দর ভবন তৈরি হচ্ছে ওটার পাশেই। সঙ্গে থাকা বন্ধুটি জানাল, এর নাম বাংলাদেশ ভবন। শুনেই আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। কারণ অন্য একটা দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের একটা মানুষ দেখলেও ভালো লাগে, আর এটা তো আস্ত একটা ভবন!
দিন যায় আর আমার বাংলাদেশ ভবন নিয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিনা কারণেই কখনো কখনো ভবনের আশপাশে সাইকেল নিয়ে চলে যাই। কোথাও গিয়ে মনে হতে লাগল আমি বাংলাদেশে এসেছি, আমি মায়ের কাছাকাছি আছি। এভাবে রোজ আসা শুরু হলো। আর দিন গুনতে লাগলাম কবে এর ভেতর ঢুকতে পারব, কী কী আছে সেটা দেখতে পারব।
গত মাসে সিনিয়রদের বিদায়ী অনুষ্ঠান চলছিল। এমন সময় স্যার এসে বললেন, ‘তোরা কে কে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে সময় দিতে পারবি।’ আমি কিছু না ভেবেই হাত তুলে ফেললাম। এই সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? নিজের দেশের জন্য যদি অল্প কিছুও করতে পারি, সেটাতেই আনন্দ।
২৪ মে বিকেলে চলে গেলাম বাংলাদেশ ভবনে। প্রথমেই যতটা পারলাম ভেতরটা ঘুরে দেখলাম। দোতলা এই ভবনে রয়েছে একটি জাদুঘর, গ্রন্থাগার এবং মিলনায়তন।
এরপর আমাদের কাজ শুরু করার পালা।
শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য মাথায় রেখেই তাজা ফুল, পাতা দিয়ে আমরা কজন সাজিয়ে ফেললাম বাংলাদেশ ভবন। এসবের মধ্যেই সাংবাদিকেরা আমাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। কখনো তাঁদের ক্যামেরায়, কখনোবা নিজেদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় আমরা ফ্রেমবন্দী হচ্ছিলাম। সবার চোখে-মুখে তখন আনন্দের ছাপ। মিলনায়তনে তখন চলছে শেষ প্রস্তুতি। সংগীত ভবনের ছাত্রছাত্রীরা গাইছে, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে…।’
পরদিন, অর্থাৎ ২৫ মে বেলা ১১টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশ ভবনে। ভবনের বাইরে দুই দেশের সাংবাদিকদের ভিড়। সঙ্গে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। যথাসময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে উদ্বোধন করলেন শান্তিনিকেতনের বাংলাদেশ ভবন। পুরো ভবন পরিদর্শন করে তাঁরা প্রবেশ করলেন মিলনায়তনে। যেখানে অতিথি ও ছাত্রছাত্রীরা সবাই অপেক্ষা করছিলেন।
সংগীত ভবনের ছাত্রছাত্রীরা যখন গাইল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, সঙ্গে আমরাও দাঁড়ালাম, তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলালাম। গানটা যখন গাইছিলাম, নিজের অজান্তেই চোখ জোড়া ভিজে যাচ্ছিল। ভিনদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গাওয়া নিজের দেশের জাতীয় সংগীত যে এতটা শিহরণ জাগায়, সেদিন টের পেয়েছিলাম প্রথমবারের মতো। এই অনুভূতিটার নামই হয়তো দেশপ্রেম।
যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলেন। এত কাছ থেকে বসে তাঁর কথা শুনছি, বিশ্বাস হচ্ছিল না।
বাংলাদেশ ভবন আসলে ভারতে দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতীক। এই ভবন দুই দেশের ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। এই মূল্যবান সময়টার সাক্ষী হতে পেরে আমি সত্যিই গর্বিত।