আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৪ কাটি টাকা, ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ও ৩১ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির প্রস্তাব রেখে আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ১২ বারের মতো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন। বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হতে পারে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ঘাটতি ৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে। প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে বাড়ছে বাজেটের আকার, রাজস্ব আয়ের টার্গেট ও ঘাটতি। এছাড়া বাজেটের একটি বড় অংশই চলে যাবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভর্তুকি ও ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে ভিশন-২০২১ পুরোপুরি বাস্তবায়ন এবং রূপকল্প-২০৪১-এর একটি রোডম্যাপ দেয়া হবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো, দারিদ্র্য বিমোচন, যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের জন্য নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের আগেই পেশ হতে যাচ্ছে ‘সমৃদ্ধ আগামীর অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট। ফলে জনকল্যাণমূলক উদ্যোগও থাকছে একাধিক। বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি। বাজেটে প্রায় ১১ লাখ দরিদ্র মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে। এর ফলে এ কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮৬ লাখ। বাজেটে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। আসন্ন বাজেটে দেশের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘বিজয় দিবস ভাতা’ হিসেবে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধা বছরে এককালীন ৫ হাজার টাকা পাবেন। পাশাপাশি অবকাঠামোসহ একগুচ্ছ জনতুষ্টির প্রকল্প হাতে নেয়া হতে পারে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলা রোধে বাজেটে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা থাকতে পারে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে থাকবে বেশকিছু পদক্ষেপসহ বৈদেশিক ঋণ এবং অনুদানের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে নতুন বাজেটে। আগামী অর্থবছরে করদাতাদের ওপর চাপাচাপি করা হবে না। বসানো হবে না নতুন করও। বরং ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হতে পারে। আবার ব্যবসায়ীদের খুশি করতে কমানো হতে পারে করপোরেট করের হার ও ভ্যাটের হার কমিয়ে ২ থেকে ৩টি করা হতে পারে। নির্বাচনের আগে ভোটারদের সামনে উন্নয়ন দেখাতে বড় বড় প্রকল্পে এরই মধ্যে বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়েছে। বড় ১০ প্রকল্পের বরাদ্দই ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে চলতি অর্থবছরে এখাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া আগামী বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ বাড়তে পারে বলে আভাস দেয়া হয়েছে। কয়েক বছর ধরে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এ খাতে তেমন ভর্তুকি রাখতে হয়নি, সরকারও স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়তে থাকায় সম্পদ কমিটির বৈঠকে জ্বালানি খাতে বড় আকারের ভর্তুকি রাখার পরামর্শ এসেছে। এছাড়া আগামী ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ দিতেও ভর্তুকি রাখতে হবে। গৃহনির্মাণ খাতে জনগণকে ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হলেও সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে নেয়া হবে ৫ শতাংশ। বাকি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতা যেমন বাড়ানো হচ্ছে, বাড়ছে সুবিধাভোগীর সংখ্যাও। একই সঙ্গে দাতাদের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্ব আরও জোরদার করতে নজরদারি আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে। রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে জনশক্তি রপ্তানির বাড়ানোসহ বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আনতে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে এবার কিছু হবে না। তবে বাজেট বক্তৃতায় এর রূপ রেখা দেয়া হবে।
সোমবার (৪ জুন) অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী বাজেটে তেমন কোন পরিবর্তন আনা হবে না। তবে কঠিন কোন বাজেটও দিব না। বাজেট সকল মানুষকে তুষ্ঠ করার জন্য দেয়া হয়। আসন্ন বাজেটে নতুন করে কোন কর আরোপ হবে না। ‘সিগারেট ও মোবাইল কোম্পানির জন্য করপোরেট ট্যাক্স ৪৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। এছাড়া ব্যাংকসহ লিস্টেড-আনলিস্টেড সব কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্সের সর্বোচ্চ হার হবে ৩৭.৫ শতাংশ। আমাদের দক্ষতা অনেক বেড়েছে। আমরা বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম ৯৫ ভাগ। কিন্তু গত দুই বছর ৮৭ ও ৮৪ ভাগ বাস্তবাযন করতে পেরেছি। তবে এ বছর আমরা ৯২ ভাগের বেশি বাস্তবায়ন করতে পারব। জাতীয় সংসদে ৭ জুন বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী। এর ছয় মাস পর জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। ফলে পুরো একটি অর্থবছরের বাজেট দিলেও অর্থমন্ত্রীর বড় নজর থাকবে মূলত প্রথম ছয় মাস।
জানা গেছে, আগামী বছরের বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৪ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশের বেশি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ হার ৭ দশমিক ৮ ভাগ। যা চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির এ আকার ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। এ বছর জিডিপির আকার হলো ২২ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের মোট জিডিপি ছিল ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার আগামী অর্থবছরের জন্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জন্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বিবিএসের মাসওয়ারি হিসেবে দেখা যায়, গত মার্চে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এদিকে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী বসতি গড়ে দেয়া হবে। এজন্য আসছে বাজেটে ৪০০ কোটি টাকা পৃথক বরাদ্দ রাখা হবে। ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত চাহিদাপত্র দাখিল করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী নতুন-পুরনো মিলিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। বিপুল সংখ্যক এই রিফিউজির বসবাসের জন্য ভাসানচর যথেষ্ট নয়। ফলে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালংসহ অন্য যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে সেগুলোতেও নতুন করে বরাদ্দ দেয়া হবে আগামী বাজেটে।
বরাদ্দ বাড়ছে এডিপিতে : আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আকার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা ধরা হতে পারে, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৪ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা বা (১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ) বেশি। মোট এডিপির মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে ৭ হাজার ৮৬৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা খরচের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এতে মূল এডিপির আকার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ২৭ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯১ হাজার কোটি টাকা। সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয় ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশের সমান। কিন্তু শেষ বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে জিডিপির প্রায় সাত শতাংশ। টাকার অঙ্কে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের তুলনায় ১৩৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) আওতায় থাকবে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি, যা মূল এডিপি হিসেবে পরিচিত। বাকিটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প। নির্বাচন সামনে রেখে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সরকারের অগ্রাধিকারের ১০টি প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৯৯ কোটি টাকা বরাদ্দ। আর পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের জন্য রাখা হয়েছে যথাক্রমে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি ও ৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। নতুন এডিপির ২৬ শতাংশ বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে। নির্বাচনের বছরে রাস্তাঘাট নির্মাণ প্রকল্পেই সাংসদদের আগ্রহ বেশি। সব মিলিয়ে আগামী এডিপিতে ১ হাজার ৪৫২টি প্রকল্প আছে। এছাড়া এডিপিতে বরাদ্দহীন ও অননুমোদিত প্রকল্প আছে ১ হাজার ৩৩৮টি।
বাজেটে বরাদ্দ কমছে মেগা প্রকল্পে : প্রায় দেড় হাজার প্রকল্পের মধ্যে সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প রয়েছে। সড়ক, রেল ও বিদ্যুৎ খাতের এসব প্রকল্পের আটটিতেই আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ থাকছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত বছর এই মেগা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০ হাজার ৯২৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে এবার মেগা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ কমেছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পটিতে বরাদ্দ থাকছে ১১ হাজার ৯৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা। প্নর ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পে আগামী এডিপিতে ৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ এর কাজ ২০১৬ সালের জুনে উদ্বোধন করা হয়। এতে আগামী এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩ হাজার ৯০২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ‘মাতারবাড়ি ২৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট’ এ আগামী এডিপিতে বরাদ্দ থাকছে ২ হাজার ১৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ’ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো/সুবিধাদির উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৫০০ কোটি টাকা পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ তৈরিতে ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের আগামী এডিপিতে বরাদ্দ রয়েছে ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।
রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা : আগামী (২০১৮-১৯) অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকবে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭৭৪ কাটি টাকা। যা চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের চেয়ে ১৮ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। চলতি (২০১৭-১৮) অর্থবছরের বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর বাইরে এনবিআর ও করবহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হতে পারে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। এদিকে করের আওতা বাড়ানোর জন্য এ বছর যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেগুলো সফল হলে আগামী বছরের বিশাল টার্গেট পূরণ করা কঠিন হবে না বলে মনে করে এনবিআর।
আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হতে পারে। সে হিসাবে এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে তা প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি। বরাবরের মতো আগামী বছরেও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট থেকে আদায় করতে হবে সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এরপরই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আয়কর আদায় করা হবে ১ লাখ ২০০ কোটি টাকা। আর শুল্ক খাতে এনবিআরকে ৮৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এবার রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৩১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ধরা হয় ৩৬ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশে রাজস্ব আয়ের গড় প্রবৃদ্ধি ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে করপোরেট কর কাঠামো সহজ করে তিন থেকে চারটি স্তরে করা হতে পারে। ‘সিগারেট ও মোবাইল কোম্পানির জন্য করপোরেট ট্যাক্স ৪৫ শতাংশ অপরিবর্তিত থাকবে। এছাড়া ব্যাংকসহ লিস্টেড-আনলিস্টেড সব কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্সের সর্বোচ্চ হার হবে ৩৭.৫ শতাংশ। এছাড়া শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও এর বাইরে ব্যাংকসহ ননলিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ছয়টি স্তরে করপোরেট কর আদায় করা হয়।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি : আগামী বাজেটে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। তবে বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে ব্যাহত না করলে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮ শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা হবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপিতে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আর গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
ভ্যাট হার : চলতি অর্থবছরের ১৫ শতাংশ একক ভ্যাট হার বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রী তা বাস্তবায়ন দুই বছর পিছিয়ে দেন। সে হিসাবে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন আইন চালু হবে। কিন্তু আগামী বাজেটেই ভ্যাট হারে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। বর্তমানে নয়টি ভ্যাট স্তর আছে। আমরা আগামী বাজেটে ভ্যাটের স্তর ৯টি থেকে কমিয়ে ৫টিতে নামিয়ে আনব এবং পরবর্তীতে আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে এই স্তর দুই থেকে তিনটি স্তরে নামিয়ে আনা। ভ্যাটের সর্বোচ্চ হারটা ১৫ শতাংশই থাকবে। নিচেরগুলো পরিবর্তন করা হবে।
বাড়ছে ঘাটতি : আগামী অর্থবছরের বাজেট শুধু আকারের দিক থেকে নয়, ঘাটতির পরিমাণও বাড়তে পারে। বাজেটে ঘাটতি ধরা হতে পারে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি ছিল ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। বিশাল পরিমাণ এই ঘাটতি পূরণ করা হবে বৈদেশিক ঋণ, অনুদান, স্থানীয় ব্যাংক ঋণ ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে। বরাবরই ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী মোটা দাগে দুটি উৎস বেছে নেন। একটি বিদেশি উৎস ও অন্যটি অভ্যন্তরীণ উৎস। অভ্যন্তরীণ উৎসের রয়েছে আবার দুটি ভাগ সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ব্যবস্থা। আগামী বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য বড় উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থাকে। আর কমিয়ে আনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ৫৯ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী বিদেশ থেকে অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে মোট ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন। আগামী অর্থবছরে বিদেশি উৎস থেকে অনুদান গ্রহণের লক্ষ্য বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। আর বিদেশি ঋণের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা আগামী বাজেটে কমানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে।
ভর্তুকি ও প্রণোদনা : আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এই খাতে চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই বরাদ্দ ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে হচ্ছে ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের সমান। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। যা এর পরের বছর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি করতে হবে বলে নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে মোট বরাদ্দ বাড়বে ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বাজেট বরাদ্দ গত পাঁচ বছর খুব বেশি বাড়েনি বা কমেনি। এই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এক প্রকার স্বস্তিতে ছিলেন অর্থমন্ত্রীও। বাজেট প্রণয়নের সময় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এই খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনার প্রবণতাই দেখা গেছে। যেমন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ভর্তুকি কম দিতে হলে সরকারের জন্য ভালো। কারণ, এই টাকাটা সরাসরি জনগণের দেয়া করের টাকা। ভর্তুকি না দিতে হলে এই টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারত। এতদিন ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল প্রধানত বিদ্যুৎ, কৃষি, রপ্তানি, খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি খাতে। এবার নতুন করে দেয়া হচ্ছে এলএনজিতে। কারণ, সরকার হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, সেই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। তাই গ্যাস ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে।