সারাদেশে এবার বোরো উৎপাদন হয়েছে আশানুরূপ। কৃষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন, ভালো মূল্য পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তারা উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। অনেকক্ষেত্রে লোকসান গুণতে হচ্ছে। কৃষকের কথা, জমিচাষ, বীজ, চারা লাগানো, পরিচর্যা, সার, কীটনাশক, সেচ, ধান কাটা ও মাড়াইসহ প্রতি বিঘায় মোটা ধান উৎপাদন খরচ পড়ছে নুন্যতম ৭শ’ টাকা। সেই ধান বাজারে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬শ’ ৫০টাকা থেকে ৭শ’ ২০টাকা। মাঝারী ও সরু ধানের মূল্যও উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য খুব বেশী নয়। বাজার বিশৃঙ্খলার কারণে সাধারণ কৃষকরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বরাবরই বঞ্চিত হন। বাজারে ফড়িয়া, মজুদদার ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের টানাহেঁচড়া চলে ধান ওঠা মৌসুমে। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি। মাঠপর্যায়ের কৃষি স¤প্রসারণ, কৃষি বিপনন ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, মাঠের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে ধান চালের মূল্য নির্ধারণ করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, বাজারে ধানের মূল্য কম অথচ নবান্নে চালের মূল্য কমছে না বরং উর্ধ্বমুখী। এর কারণ কি, গলদ কোথায়, তা নির্দ্দিষ্ট করে বলতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগই। তবে বলেছে তদন্ত করলে মূল কারণ চিহ্নিত করা যাবে। এক মণ ধানে গড়ে ২৭কেজি চাল উৎপাদন হয়। যার মূল্য মোটা প্রসেসিং চাল ৩৬টাকা কেজি হিসাবে প্রতি মণের মূল্য মোট ৯শ’ ৭২টাকা। গড়ে ৭শ’ টাকা প্রতিমণ ধান ক্রয় করে পাইকারী ব্যবসায়ী, আড়তদার, মিলাররা লাভ করে প্রায় ৩শ’ টাকা। মাঠ থেকে বাজারে উঠার পর ধান মিলারদের কাছে গেলেই প্রথমেই বড় ধরণের মুনাফা কষে নেওয়া হয়। খাদ্য অধিদপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত বছরে যখন চালের মূল্য অস্বাভাবিক হয় তখন কারসাজি কোথায় তার তদন্ত করা হয় সারাদেশের বিভিন্নস্থানে। তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখিত হয় পাইকারী ব্যবসায়ী, মিলার ও সিন্ডিকেট প্রতি কেজিতে ১০/১২ টাকা লাভ করে। সংগ্রহ, শুল্কমুক্ত আমদানীর সুবিধা নির্দ্দিষ্ট কয়েকটি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী থাকছে কয়েকটি বছর। সরকার নয় তারাই নিয়ন্ত্রণ করে বাজার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীনের কাছে কৃষকরা ধানের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না এর কারণ কী জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, আমরা প্রোডাকশন দেখি, মূল্যের বিষয় আমাদের নয়। তিনি জানান, চলতি মৌসুমে বোরো ধানের উৎপাদন খুবই ভালো হয়েছে। চাল উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি ৯৭লাখ মেট্রিক টন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো প্রোডাক্ট প্রসেসিং টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, উৎপাদক চাষির স্বার্থ সংরক্ষণ সবচেয়ে জরুরি। তারা অব্যাহত মার খেলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে’। খাদ্য অধিদপ্তরের একটি সুত্র জানায়, অধিদপ্তর ধান ক্রয়ের ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে শুধু চাল ক্রয়ের। ধান ক্রয়ের কথা ছিল দেড় লাখ মেট্রিক টন। এখন মাত্র বরিশাল ও সিলেট বিভাগ থেকে মাত্র ১৫ হাজার মেট্রিক টন ধান ক্রয় করবে। অধিদপ্তর চাল ক্রয় করবে ৩৮টাকা কেজি দরে ৮লাখ মেট্রিক টন। সুত্রমতে, এতে মিলারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে কৃষকদের নয়।
যশোরের শার্শা উপজেলা ডিহি ইউনিয়নের কৃষক মোঃ আলম জানালেন, ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো পর বস্তা ভর্তি করে বাজারে তোলার পর কৃষকের চোখ কপালে উঠছে। মোটা ধানের মূল্য প্রতিমণ ৬শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭শ’ ২০ টাকা। সারাদেশের প্রায় সবখানে একই চিত্র। কৃষকরা ভালো নেই। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় তার জের টানতে হচ্ছে কৃষকদের। আবার ভোক্তাদেরও বাড়তি মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে চাল। এসব বিষয় যাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তারাই উৎকোচের বিনিময়ে মজুদদার, পাইকারী ব্যবসায়ী ও মিলারদের ফ্রিস্টাইলে কাজকর্ম করার সুযোগ দেয় বলে বিস্তর অভিযোগ। সুত্র জানায়, ১৯৬৪ সালের এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটস রেগুলেশন এ্যাক্ট ও ১৯৮৫ সালের সংশোধিত বাজার নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৬(১) ও ১৬(২) ধারামতে কৃষিজাত ও ভোগ্যপণ্যের ক্রয়মূল্য, বিক্রয়মূল্য ও মজুদ পরিস্থিতির তদারকির ক্ষমতা রয়েছে কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের বাজার কর্মকর্তাদের। কিন্তু বাস্তবে কোথাও আইনটির প্রয়োগ হতে দেখা যায় না। তাছাড়া ১৯৫৩ সালের মজুদবিরোধী আইন ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনেরও প্রয়োগ নেই। মুক্ত বাজার অর্থনীতির কোপানলে ওইসব আইন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।