অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত ‘সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি’র খসড়া কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়া কাঠামোতে কীভাবে এ ব্যবস্থা পরিচালনা করা যায়, সে বিষয়ে বিশদ রূপরেখা তুলে ধরা হবে। আগামী ২০১৮-১৯ বাজেটে এটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেবেন মুহিত।
অনেক দিন থেকেই খবর টি ভেসে বেড়াচ্ছে কানে কানে। যে বেসরকারি চাকরিও সরকারি চাকরির মত পেনসনের আওতায় আসবে। কিন্তু তা নিয়ে নির্দিষ্ট ভাবে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি সরকার থেকে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রথম এই বক্তব্য উন্মোচন করা হয়। দুই বছর পার হলেও এটি শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই রয়েছে। এ সময়ে দৃশ্যমান তেমন কিছু করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। এ নিয়ে তার আক্ষেপও রয়েছে।
এ পদ্ধতি কার্যকর হলে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো বেসরকারি খাতে যারা চাকরি করেন, মাসিক পেনশন সুবিধা পাবেন তারাও। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতি বাস্তবায়নের কাজ আগামী অর্থবছর থেকে শুরু হবে। দীর্ঘমেয়াদি এ পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ কার্যকর হতে কমপক্ষে তিন-চার বছর সময় লাগবে। তারপরই এর সুফল মিলবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, আগে সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি চাকরিজীবীরা সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় থাকবেন। এখন সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শুধু বেসরকারি চাকরিজীবীদের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয় নতুন করে। এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান প্রস্তাবিত খসড়া কাঠামোতে সুবিধাভোগীর আওতা ব্যাপক বাড়ানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। খসড়ায় বেসরকারি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল চাকরিজীবীকে এ আওতায় আনা হচ্ছে। এ ছাড়া গরিব জনগণ যারা নিয়মিত আয় করেন, তারা যেন সুবিধা পেতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকছে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতির উদ্যোগ ভালো, তবে বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন. সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতির উদ্যোগ ভালো। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে বেসরকারি পেনশনভোগীরা উপকৃত হবেন। তিনি মনে করেন, এটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে। কারণ, বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করতে হবে সরকারের।
তারা রাজি না হলে বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে বেশিরভাগই ছোট ছোট কোম্পানি। অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপত্রও দেওয়া হয় না। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রস্তাবিত পেনশন সুবিধার আওতায় আনা কঠিন হবে। তবে সীমিত আকারে চালু করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, প্রস্তাবিত পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ চাকরিজীবী ও নিয়োগ কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ জোগান দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। অন্যদিকে, সমপরিমাণ টাকা দেবে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। সরকারি এবং বেসরকারি খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে। প্রস্তাবিত পেনশন ব্যবস্থার আওতায় পেনশনভোগীর বয়স সর্বোচ্চ ৬৫ নির্ধারণ করা হতে পারে।
তহবিল পরিচালনা করবে ‘ন্যাশনাল পেনশন অথরিটি’। সরকার তা গঠন করবে। তহবিলে যে টাকা জমা হবে বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে এ টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এ জন্য সরকার প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেবে।
তারা লাভজনক খাতে তহবিলের ওই অর্থ বিনিয়োগ করবে। ওই বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কোথায় বিনিয়োগ করা হবে, কী ভাবে করা হবে, সে বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করা হবে। ওই নীতিমালার আলোকে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করা হবে।
বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা ভোগ করছেন। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে ক্ষেত্রবিশেষ প্রভিডেন্ট ফান্ড থাকলেও অবসরের সময়ে মাসে মাসে পেনশন পান না।
এ ক্ষেত্রে সমতা ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদেরও পেনশনের আওতায় আনার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ বিষয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী। ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ দিতে আসন্ন বাজেটে পদক্ষেপ নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।
পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খাতের প্রতিনিধিদের আনার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বর্তমানে সরকারি খাতে চাকরিজীবী প্রায় ১৫ লাখ, যা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ ভাগ। তারা সবাই পেনশন সুবিধা পান। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের ৯৫ শতাংশের মধ্যে মাত্র আট ভাগ ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের কোনো পেনশন সুবিধা নেই।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, দেশে গড় আয়ু ও প্রবীণের সংখ্যা বাড়ার কারণে সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঝুঁকি মোকাবেলা করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তা প্রতিকারে প্রবর্তন করা হচ্ছে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা।
সূত্র জানায়, সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আওতায়, বেসরকারি পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে বড় বড় করপোরেট হাউস, শেয়ারবাজারে লিস্টেড কোম্পানিতে কর্মরত চাকুরেদের আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। সূত্র-সমকাল।