রমজান মাসে চকবাজারে ইফতার কিনতে গেলে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তাহলো, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’ রকমারি ইফতার বাজারের একটি জনপ্রিয় আইটেম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী এই পদটি প্রায় ৮০ বছরের পুরনো। অনেকের জানা, ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম। ইফতারে এই খাবার বেশ জনপ্রিয়।
‘বড় বাপের পোলায় খায়’ তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ১৬ ধরনের মসলা প্রয়োজন। আর মোট ৩১টি পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’।
একটি বড় গামলায় এই ৩১ ধরনের পদ দুই হাতে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। এটি কিনতে ছোট-বড় সব বয়সী রোজাদারের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়। ১৫ রকমের পদ আর ১৬ রকমের মসলার সমন্বয়ে তৈরি খাবারটি ছাড়া ইফতার জমে না পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের। খাবারের বাহারি আয়োজন দেখলেই যেন জিহ্বায় পানি আসে। আর ঘ্রাণ? সে তো অর্ধেক ভোজনের সমান। তাই তো ঢাকাবাসীর কাছে পুরান ঢাকার চকবাজারের এই ইফতারের চাহিদা অন্যরকম।
প্রচলিত আছে, যার হাত দিয়ে এই খাবারের উৎপত্তি, তিনি হলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা দাতা মোহাম্মদ কামাল মাহমুদ। তিনি বরাবরই ভোজনরসিক ছিলেন। নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করতে জানতেন। এই খাবারটিও তারই সৃষ্টি। প্রায় ৮০ বছর আগে তিনিই প্রথম এই খাবার তৈরি করে চকবাজারে বিক্রি শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলমান।
বড় বাপ, দাদা, বাবা থেকে চার পুরুষ ধরে রমজানে চকবাজারে ইফতার বিক্রি করছেন মোহাম্মদ হোসেন। তিনি জানান, পাকিস্তান আমলে তার বাপ-দাদা বিক্রি করতেন ঐতিহ্যবাহী ইফতারি শেখ চুরা ভর্তা। ধীরে ধীরে খাবারটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই খাবারের নাম বদলে যায়। যদিও এর কারণ এখন আর জানা যায় না। এরপর খাবারটির নতুন নাম হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। এখানেই নামটি সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থানীয় বিক্রেতাদের মুখে মুখে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বাক্য: ‘ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়’।
ইতিহাস যাই হোক না কেন, মোগল আমলের ঐতিহ্যের ছাপ ও ছোঁয়ার এসব ইফতারি কালক্রমে ঢাকার সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও এখনো পুরান ঢাকার ইফতারের ঐতিহ্য কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। শুধু ঐতিহ্য নয়, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাহারি আয়োজন। ফলে খানদানি ইফতারি মানেই পুরান ঢাকার ইফতার সামগ্রী।
সত্যি বলতে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ পুরান ঢাকার ইফতারে ব্যতিক্রম এক আয়োজন। এখনো পুরান ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের এটি ছাড়া ইফতার জমে না, পূর্ণতা পায় না। নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এই খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বর্তমানে মূল্য প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত।
চকবাজারে এই আইটেম ছাড়াও রয়েছে আরো শত রকমের ইফতার সামগ্রী। এর মধ্যে বেগুনি, সবজি, পিঁয়াজু, পাকোড়া, আলুর চপ, ডিমের চপ। মুরগির রোস্টের, কবুতরের রোস্ট, কোয়েলের রোস্ট, গরুর কাবাব, খাসির কাবাব এবং সুতি কাবাব। এর বাইরে সবজির কাঠি কাবাব, গরুর কাঠি কাবাব এবং মুরগির কাঠি কাবাব।
রয়েছে খাসির পায়া, মুরগির মাংস ভাজা, গরুর মাংস ভাজা, ফালুদা, ফিন্নি, বড় ও ছোট বোতলে লাবাং। রসালো খাবারের মধ্যে রয়েছে দইবড়া, দুধের পনির, বোরহানি, পেস্তা শরবত এবং মাঠা। শুধু তাই নয়। রয়েছে আচারের হরেক বাহার। আম, চালতা ও ত্রি-ফলার মোরব্বা এবং বরই, তেঁতুল, জলপাইয়ের আচার, খেজুর ও শাহী জিলাপিও রয়েছে।
খাদ্যের রসনা বিলাস বাঙ্গালির শত শত বছরের পুরাতন ইতিহাস। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখে এখনো পুরান ঢাকার বুকে চলছে শত বছরের বাহারী রকমের ইফতার। সেসব মুখরোচক ইফতার হোক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং সবার জন্য দামের দিক দিকে অনুকুল।