পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশী যে রোগীদের রোজা নিয়ে গবেষণা হয়েছে তা হলো ডায়াবেটিস। আমরা আগেই জেনেছি, রোজার সময় একজন সাধারণ মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত থাকে। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন নামক হরমোনটি তৈরী হয় না অথবা বিভিন্ন কোষে হরমোনটির গ্রাহক অণূর সংবেদনশীলতা কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বজায় রাখার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এ কারণে রোজায় দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে ডায়াবেটিস রোগীদের বিভিন্ন ধরণের জটিলতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। যেমন: হাইপোগ্লাইসেমিয়া তথা রক্তে গ্লুকোজের প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে কমে যাওয়া, হাইপারগ্লাইসেমিয়া তথা রক্তে গ্লুকোজ সহনীয় পর্যায়ের উপরে উঠে যাওয়া, ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস এবং পানিশূন্যতা।
সাধারণত যে সকল ডায়াবেটিস রোগী ইনসুলিন এবং সালফোনাইলইউরিয়া। যেমন- গ্লিক্লাজাইড, গ্লিমেপিরাইড জাতীয় ওষুধ সাহরীর সময় ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে দিনের শেষ প্রান্তে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যে সকল রোগী রমযান মাস এলে চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ বাদ দেন অথবা ইচ্ছেমত সময়সূচি পরিবর্তন করেন অথবা ইফতার ও সাহরীর সময় অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করে ফেলেন তাদের হাইপারগ্লাইসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে যাদের ডায়াবেটিস ইনসুলিন ব্যবহার ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আছে তারা চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে রোজা রাখতে পারবেন। রমযান মাসে ডায়াবেটিস রোজাদারদের ডায়াবেটিস চিকিত্সায় আমেরিকান ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর অধীনে বিভিন্ন দেশের মুসলিম চিকিৎসকদের একটি দল কিছু দিক নির্দেশনা প্রণয়ন করে। উক্ত দিন নির্দেশনা অনুসারে রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীদের চারটি ক্যাটাগরীতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন: ভেরি হাই রিস্ক, হাই রিস্ক, মোডারেট রিস্ক এবং লো-রিস্ক।
সাধারণত ভেরি হাই রিস্ক ও হাই রিস্ক ক্যাটাগরীর রোগীদের রোজা না রাখতে বলা হয় এবং মোডারেট রিস্ক ও লো-রিস্ক রোগীদের রোজা রাখার অনুমোদন দেয়া হয়।ডায়াবেটিস রোগী সাহরীর সময় কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট তথা ভাত, রুটি, আলুকে প্রাধান্য দিবেন। ইফতারের খাবারে সরল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার যেমন: মিষ্টি ফল যেমন: খেজুর, আম, অল্প চিনিতে বানানো খাবার খাওয়া যেতে পারে। সাহরী, মধ্যরাতের খাবার এবং ইফতারের খাবার রমযানের পূর্বের ন্যায় সুষম হতে হবে। রমযান মাসে অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম পরিহার করতে হবে এবং নিয়মিত শরীর চর্চার সময় পরিবর্তন করে ইফতারের পরে নেয়া উত্তম। বিশ রাকাত তারাবীহ নামাযে অংশগ্রহণ করাকেও শরীর চর্চার রুটিন হিসেবে নেয়া যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- রোজা রাখা অবস্থায় কারও রক্তে সুগার ৩.৩ মিমোল-এর নেমে আসা মাত্রই রোজা ভেঙ্গে মিষ্টি কিছু খেতে হবে। অন্য দিকে রক্তের সুগার ১৬.৭ মিমোল-এর উপরে উঠে গেলেও রোজা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রাখার মূল শর্ত হলো
ডাক্তারের পরামর্শমত শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে নেয়া। রমযানের ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলী নিয়ে সবচেয়ে বেশী জটিলতা দেখা দেয় ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত: শরীরের ইনসুলিন তৈরী হচ্ছে কি না তার উপর ভিত্তি করে ডায়াবেটিস রোগীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়। মেডিকেলের ভাষায় এদের বলা হয়: টাইপ-১ এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস মেলাইটিস। টাইপ-১এ ইনসুলিন তৈরী হয় না, ফলে এদের চিকিত্সায় ইনসুলিন ছাড়া অন্য কোন ওষুধ কাজ করে না। টাইপ-২-এ ইনসুলিন তৈরী হয়। কিন্তু হয় পরিমাণে কম থাকে অথবা ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা কমে যায়। এ সকল রোগীর ক্ষেত্রে ইনসুলিন অথবা বিভিন্ন মুখে খাওয়ার ওষুধ দেয়া হয়।
যে সকল টাইপ রোগীর ডায়াবেটিস ওষুধ এবং ডায়েট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে থাকে তাদের রমযানের পূর্বের ন্যায় ডায়েট গ্রহণ করবেন। শুধু শরীর চর্চার মাত্রা ও সময় পরিবর্তন করে নিতে হবে।