রাবেয়া এখন পড়ে-খেলে, রোকাইয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তা

৮ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। পিচঢালা ৮ কিমি পথ পেরিয়ে তপ্ত দুপুরে যখন বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁ’টা দুপুর একটার ঘরে। রাবেয়া-রোকাইয়াদের বাড়িতে প্রবেশের পর দেখা গেল, নিজেদের ঘরে রাবেয়া তার বড় বোন রাফিয়ার সাথে মোবাইলে গেমস খেলায় ব্যস্ত। সাথে রয়েছে সমবয়সী প্রতিবেশী শি’শুরা। শিক্ষক বাবা রফিকুল ইস’লাম গেছেন স্কুলে। আর মা তাসলিমা খাতুন ব্যস্ত রান্নার কাজে। বাড়িতে ফেরার পর থেকে খুবই উৎফুল্ল রাবেয়া। সবার সাথে স্বাভাবিক শি’শুর মতো হেসে খেলে দিন কাটছে তার। তবে এখনও প্যারালাইজড অবস্থায় দিন কাটছে আরেক বোন রোকাইয়ার। জোড়া মা’থার জমজ দুই বোন আলাদা হওয়ায় আনন্দের পাশাপাশি দুশ্চিন্তা রয়েছে- কবে পুরো সুস্থ হবে রোকাইয়া। রাবেয়া-রোকাইয়ার বয়স এখন ৪ বছর ৮ মাস।

সবার মনে আছে নিশ্চয়ই, জোড়া মা’থার সেই জমজ শি’শু রাবেয়া-রোকাইয়ার কথা। দীর্ঘদিনের চিকিৎসা ও জটিল অ’পারেশন শেষে যারা কিছুদিন আগে নিজেদের বাড়িতে ফিরেছে। তাদের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজে’লার মুলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকা গ্রামে। আর বাড়ি ফেরার পর ছোট ছোট শি’শুদের সাথে খেলা করে সময় পার করছে রাবেয়া। এর পাশাপাশি পড়াশোনা শিখতে শুরু করেছে রাবেয়া। ইতিমধ্যে সে স্বরবর্ণ শিখেছে, ব্যঞ্জনবর্ণ শিখছে। এতে খুশি তাদের বাবা-মাসহ স্বজনরা।

রাবেয়ার সাথে কথা বলে তার অনুভূতি জানার চেষ্টা করলে প্রথমে লজ্জায় কথা বলতে চায় না। বেশ কিছু সময় তার সাথে নানা ধরনের মজার সব কথা বলতে এবং জিজ্ঞেস করতে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর জানায়, বাড়িতে আসার পর তার ভালো লাগছে। তার অনেক ভাইবোন। বড় বোনের সাথে পুকুরে গোসল করার কথা জানায় সে। খেলাধুলা করে, অনেক গল্প করে। সে পড়াশোনা করতে পারে বলেও জানায়।

আলাপকালে মা তাসলিমা খাতুন জানালেন, রাবেয়া অনেকটাই স্বাভাবিক শি’শুর মতো সবার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলছে, কথা বলছে। খুব আনন্দ অনুভব করছে ও। কিন্তু রোকাইয়া প্যারালাইজড অবস্থায় রয়েছে। সব বোঝে, শোনে, কিন্তু কথা বলতে পারে না। চোখেও দেখতে পায় না। চলাফেরা করার শক্তিও নেই তার। শুধু খাওয়া, ঘুমই যেন সঙ্গী। আম’রা নানাভাবে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করি। অ’পরদিকে, রাবেয়া খুবই চঞ্চল। কিছু জিজ্ঞেস করলে লাজুক হয়ে যায়। তবে বন্ধুত্ব করতে পারলে তার সাথে খুব গল্প করে।

রাবেয়া-রোকাইয়ার বড় বোন তাসনিম ইস’লাম রাফিয়া (১০)। সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। সে জানায়, বাড়িতে আসার পর ছোট দুই বোনকে নিয়ে আমি সবসময় খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকি। বিশেষ করে রাবেয়া আমাকে খুব ভাল বোঝে। সারাক্ষণ আমা’র সাথে দুষ্টুমি করে। আমা’র সাথে গোসল, খাওয়া, ঘুমানো সব করে। কিন্তু রোকাইয়াকে নিয়ে চলতে পারি না। ও তো হাঁটতে পারে না, সেজন্য।

বাড়িতে আসার পর সর্দি-জ্বরে অ’সুস্থ হয়ে পড়ে রাবেয়া-রোকাইয়া। এদের মধ্যে রাবেয়া তিন দিন ও রোকাইয়া এক সপ্তাহ অ’সুস্থ ছিল। পরে ওষুধ খাওয়ার পর এখন তারা সুস্থ। মা তাসলিমা জানান, রাবেয়া হাঁটাচলা, কথা বলা, শোনা সব করতে পারে। খুব চঞ্চল। বাড়িতে এসে রাবেয়া খুব খুশি। নানারকম প্রশ্ন করে সব জানতে চায়। ঢাকায় হাসপাতা’লে ছিলাম এক পরিবেশে। এখন গ্রামে এসে আরেক পরিবেশ। ধীরে ধীরে সবকিছু মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। রোকাইয়াকে মাঝে মধ্যেই থেরাপি দিতে হয়। না হলে অ’সুস্থ হয়ে পড়ে। দুই বোন রান্না করা খাবার খেতে পারে। বাইরের কোনো খাবার তারা খেতে চায় না। রাবেয়া বলে, হাসপাতাল থেকে আমাদের বাড়িটাই ভাল। আমি আর হাসপাতা’লে যাবো না। রোকাইয়াকে কোলে নিয়ে বেড়াতে হয়। কখনও বিছানায় থাকে। দুপুরে খাবার খেয়ে দুই বোনই ঘুমায়। রাবেয়ার বর্তমানে কোনো ওষুধ লাগে না। তবে রোকাইয়াকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াতে হয়। আমি তো জোড়া মা’থার জমজ সন্তান নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। প্রথমে তো সরকারের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। মিডিয়া কর্মী ও স্থানীয় এমপির মাধ্যমে সরকারপ্রধানের নজড়ে আসি। যার কারণে অনেকেই রাবেয়া-রোকাইয়াকে দেখার জন্য বাড়িতে আসে। এতে বির’ক্ত হই না।

বাবা রফিকুল ইস’লাম জানান, বাড়িতে ফেরার পর লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছে রাবেয়া। ইতিমধ্যে সে স্বরবর্ণগুলো পড়া ও লেখা শিখেছে। এখন ব্যঞ্জনবর্ণ শিখছে। ডান হাত দুর্বল হওয়ায় বাম হাতে লিখতে পারে রাবেয়া। আর রোকাইয়ার চোখে সমস্যা আছে। গভীর ও গাঢ় আলো দেখতে পায়। কম আলোতে তার সমস্যা হয়। দৃষ্টিশক্তি তার অনেক কম। চিকিৎসকরা বলেছেন, ধীরে ধীরে তার সমস্যার উন্নতি হবে। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর। আর কৃতজ্ঞতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। যার সহযোগিতা ছাড়া মা’থা জোড়া জমজ দুই বোন আলাদা হতে পারতো না।

মা তাসলিমা খাতুন বলেন, আমি আশ্চর্য হয়েছি এই ভেবে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমা’র মে’য়ে দুইটার এতদিন ধরে খোঁজ রেখেছেন, এত টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনও খোঁজ নেননি বা জানতে চাননি রাবেয়া-রোকাইয়ার বাবা-মা কোন দল করে? বরং ডা. সামন্ত লাল সেন যতবার আমা’র মে’য়েদের চিকিৎসার ফাইল নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেছেন, তিনি ততবারই বলেছেন, ওদের দায়িত্ব আমা’র। এতবার আমা’র কাছে আসার দরকার নাই। কী’ লাগবে বলো? এত বড় মহানুভবতার পরিচয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন যা কোনোদিন ভুলবো না।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৬ জুন সিজারিয়ান অ’পারেশনের মাধ্যমে জন্ম নেয় জোড়া মা’থার জমজ শি’শু রাবেয়া-রোকাইয়া। জন্মের পর থেকে দুশ্চিন্তা ভর করে শিক্ষক দম্পতি বাবা-মা রফিকুল ইস’লাম ও তাসলিমা খাতুনের। কী’ভাবে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। সেই খবর পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি দায়িত্ব নেন রাবেয়া-রোকাইয়ার চিকিৎসার। এরপর ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তির পর দেশি-বিদেশি অ’ভিজ্ঞ চিকিৎসদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে চলে চিকিৎসা ও জটিল অ’পারেশন। দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর চিকিৎসা শেষে গত ১৫ মা’র্চ বিকেলে বাবা-মায়ের সাথে বাড়ি ফেরে রাবেয়া-রোকাইয়া। তাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।