পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের শর্ত শিথিল

পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে অপ্রদর্শিত আয়, অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। নিয়মিত ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে তিন বছর ‘লক ইন’ বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ছিল। এটি কমিয়ে এক বছর করা হয়েছে। এ ছাড়া লোকাল অথরিটির উৎস ভ্যাটের রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সিএনজি রেজিস্ট্রেশনে সম্পূরক শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এগুলোসহ কয়েকটি সংশোধনী এনে অর্থ বিল-২০২০ জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। তবে এবারের বাজেটের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর প্রস্তাবিত অতিরিক্ত সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়নি। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে বেশি টাকা দিয়েই কথা বলতে হবে। গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অর্থ বিল-২০২০ কণ্ঠভোটে পাস করা হয়। এ সময় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে অভিবাদন জানান। তবে করোনা সতর্কতার কারণে সংসদে উপস্থিতি ছিল সীমিত। আজ মঙ্গলবার ৩০ জুন সংসদে মূল বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে, যা আগামীকাল বুধবার ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ, গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রেও দেওয়া হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোনো শেয়ারে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা বিনিয়োগ করলে তিন বছরের ‘লক ইন’ বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার শর্ত দেওয়া হয়। শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে যে কেউ তার কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে সঞ্চিত অর্থ এসব খাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কোনো জরিমানা গুনতে হবে না। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ ওই টাকার উৎস জানতে চাইবে না। পুঁজিবাজারে তিন বছরের ‘লক ইন’ পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এ দাবি মেনে নিয়ে অর্থ বিলে পুঁজিবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগের শর্ত আরো শিথিল করা হয়েছে। তিন বছরের ‘লক ইন’ সময় কমে এক বছর করা হয়েছে। এর ফলে ১০ শতাংশ কর দিয়ে এক বছর ‘লক ইন’ রেখে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো সংস্থা অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তুলবে না।

প্রস্তাবিত বাজেটে জিরো কুপন বন্ডের বিদ্যমান কর সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) সংশ্লিষ্টদের অনুরোধে তা আবারও আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ নিয়ে। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও তা পরিবর্তন করা হয়নি। কয়েকজন সংসদ সদস্যের সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সংসদে যে অর্থ বিল পাস হয়েছে, তাতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের প্রস্তাব ছিল না। অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলা, মেসেজ পাঠানোসহ অন্যান্য সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ১ শতাংশ সারচার্জ, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ বহাল থাকছে। এতে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে সরকারের পকেটে যাবে ২৫ টাকা।

সংশোধিত অর্থ বিলের মাধ্যমে উপকরণ কর রেয়াতের শর্ত বাতিল করা হয়েছে। অর্থাৎ আগের নিয়মেই শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তারা উপকরণ কর রেয়াত নিতে পারবেন। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছিল, আমদানির চার মাসের মধ্যে উপকরণ ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করতে না পারলে রেয়াত বাতিল করা হবে।

ভ্যাট আপিলের কিছু ছাড় দেওয়া হলেও তাতে আগের হারেই শিল্প মালিক ও উদ্যোক্তাদের অগ্রিম অর্থ জমা দিতে হবে। ভ্যাট আপিলের ক্ষেত্রে বিধান পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আপিল কমিশনার ও আপিলাত ট্রাইব্যুনালে ভ্যাট আপিলের ক্ষেত্রে করের ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ অর্থ জমা দেওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়। সংশোধিত অর্থ বিলের মাধ্যমে করের ২০ শতাংশ জমার বিধান রাখা হয়েছে।

এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব এলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ করা হয়। অর্থ বিলে সরকারি, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির কয়েকজন সদস্য সংশোধনী প্রস্তাব আনেন, এসব প্রস্তাবের মধ্যে কিছু গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। প্রথা অনুযায়ী, অর্থ বিলে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে অর্থমন্ত্রীর সমাপনী বক্তব্য এবং অর্থ বিল পাসের আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীকে সে বিষয়ে অনুরোধ করেন। অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ আমলে নিয়ে সেসব বিষয়ে পরিবর্তন এনে অর্থ বিল পাসের প্রস্তাব করেন। কিন্তু এবার প্রধানমন্ত্রী কোনো পরিবর্তন আনতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেননি।

আজ বাজেট পাস : ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাস হবে আজ মঙ্গলবার। গত ১১ জুন অর্থমন্ত্রী সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন, যা দেশের মোট জিডিপির ১৭.৯ শতাংশের সমান। করোনাভাইরাস সংকটে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় খুব বেশি না বাড়িয়ে ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার ০৪৩ কোটি টাকা, যা বিদায়ি অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের প্রায় ৬.২৭ শতাংশ বেশি।

প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসাবে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। এই বাজেটে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশের মতো।