মেয়েদের যে রোগ হয় ঠিকঠাক সহ বাস না করলে….

মনোসমীক্ষার তত্ত্বানুযায়ী, আমাদের মনের অবচেতন অংশে বাস করে মানব অাদিসত্তা বা সহজাত প্রবৃত্তি, যার সঙ্গে বাহ্যিক পরিবেশের সংঘাত হলেই সৃষ্টি হয় মানসিক দ্বন্দ্বের, যা দীর্ঘদিন সহ্য করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে মনের অগোচরেই কিছু মানসিক ক্রিয়া এই প্রবৃত্তিগুলোকে অবদমন করে। কিন্তু এই অবদমনকারী শক্তিগুলো যখনই কোনো কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সেই অবদমিত কামনাগুলো সচেতন মনে উঠে আসতে চায়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে নানা শারীরিক লক্ষণে। একেই বলে হিস্টিরিয়া।

রোগীর মানসিক দ্বন্দ্ব শারীরিক লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পাওয়ায় এর অারেক নাম কনভার্সন ডিসঅর্ডার। অনিচ্ছাকৃতভাবে এটি রোগীর অবচেতন মন থেকে প্রকাশ পায়। সাধারণত নারী-পুরুষ উভয়েরই হিস্টিরিয়া হতে পারে। তবে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে এর আধিক্য দেখা যায়।

ইতিহাস: হিস্টিরিয়া শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন গ্রিক চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটাস। এর উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘হিস্টেরা’ থেকে, যার অর্থ জরায়ু। একসময় মনে করা হতো, নারীর জরায়ুর কোন অস্বাভাবিক অবস্থার কারণেই হিস্টিরিয়ার সৃষ্টি।

১৮১৫ সালে ফরাসি চিকিৎসাবিদ জেন মার্টিন চারকোট সম্মোহন পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেখান, সম্মোহিত অবস্থায় রোগীর মনে যদি এ ধারণা সঞ্চার করা যায় যে, সে সুস্থ হয়ে গেছে, তাহলে তার মধ্য থেকে রোগের উপসর্গগুলো লোপ পায়। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, হিস্টিরিয়ার সাথে অামাদের অবচেতন মনের সম্পর্ক রয়েছে। পরবর্তীতে মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড একে তার মনোসমীক্ষার তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখা করেন। হিস্টিরিয়া জরায়ুর রোগ, ফ্রয়েড এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটান ও একে মস্তিষ্কের রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন ।

১৯৮০ সালের অাগপর্যন্ত রোগটি ‘Hysterical Neurosis’ নামে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের তৈরি মানসিক রোগের শ্রেণীবিন্যাসের ৩য় সংস্করণে (DSM-III) পরিচিত ছিলো। ১৯৮০ সাল থেকে এটি ICD-10 এর ‘Conversion Disorder’ নামক ডিসোসিয়েটিভ ডিসঅর্ডার হিসেবে স্থান পায়।

শ্রেণীবিন্যাস: হিস্টিরিয়াকে লক্ষণের ওপর ভিত্তি করে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১. কনভারশন হিস্টিরিয়া: এই হিস্টিরিয়ায় রোগের শারীরিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- শরীরে অসাড়ভাব, হাত-পা অবশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।২. ডিসোসিয়েটিভ হিস্টিরিয়া: এই হিস্টিরিয়ায় রোগের মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- খিঁচুনি, ঘুমের মধ্যে হাঁটা ইত্যাদি।

কারণ: হিস্টিরিয়ার মূল কারণ মানব মনের অবদমিত মানসিক দ্বন্দ্ব, কিন্তু আরও অনেক কারণে হিস্টিরিয়া হতে পারে।মানসিক দ্বন্দ্ব: সংবেদনশীল ব্যক্তিমন যখন পরিবেশগত মানসিক চাপ বা দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়, তখন অবদমিত ক্ষোভ থেকে হিস্টিরিয়ার সংক্রমণ দেখা যেতে পারে। যেমন- কাউকে শারীরিক, মানসিক অথবা যৌন নিপীড়ন করা হলে, কোনো কারণে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তারা যদি বিষয়টি প্রকাশ করতে না পারে, তখন তাদের মধ্যে হিস্টিরিয়ার সংক্রমণ দেখা যায়।

ব্যক্তিত্বের অন্তর্মুখীতা: যারা অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তারা নিজেদের মনের অনুভূতি সহজে প্রকাশ করতে পারে না। অন্যদিকে যাদের ব্যক্তিত্ব বহির্মুখী, তারা নিজেদের মনের অনুভূতি সহজে প্রকাশ করে ফেলায় মানসিক দ্বন্দ্ব মন থেকে চলে যায়। ফলে বহির্মুখীদের তুলনায় অন্তর্মুখীদের এ রোগে অাক্রান্ত হবার অাশঙ্কা বেশি।

পরিবেশগত নিয়ামক: ভয়, দুশ্চিন্তা, হতাশা, অনিয়মতান্ত্রিক জীবন-যাপন, মানসিক অবসাদ, মানসিক আঘাত, ট্রুমাটিজম, দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতা, মৃত্যুশোক বা প্রেমে প্রত্যাখ্যান থেকে হিস্টিরিয়া দেখা দিতে পারে।

মস্তিষ্কের সমন্বয়হীনতা: মানব মস্তিষ্কের বাম ও ডান অংশের ক্রিয়ার সমন্বয়ের অভাবে হিস্টিরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। এছাড়া মস্তিষ্কের ব্যাসাল গ্যাংলিয়া ও থ্যালামাস এ দুটি অংশকে হিস্টিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়।

বংশগতির প্রভাব: কারো রক্ত-সম্পর্কীয় অাত্মীয়ের (মা, খালা কিংবা বোন) পূর্বে থেকে এই রোগ থেকে তাদের হিস্টিরিয়া কনভার্সন ডিজঅর্ডারে অাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি হয়।

উপসর্গ: হিস্টিরিয়ার উপসর্গ বা লক্ষণগুলো খুবই নাটকীয়ভাবে উপস্থিত হতে পারে। একা থাকলে বা ঘুমের মধ্যে লক্ষণগুলো খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় না। অাবার মনোযোগ পেলে লক্ষণগুলোর প্রকটতা অনেকাংশে বেড়ে যায়।

শারীরিক লক্ষণগুলো প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর অবদমিত ইচ্ছাগুলোর ইঙ্গিতময় প্রকাশকে বলা হয় প্রাথমিক অর্জন (Primary Gain)। আর এর মাধ্যমে পরিবেশ থেকে সহানুভূতি অর্জন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে রেহাই পাওয়াকে বলে হিস্টেরিক অর্জন (Hysteric Gain)। হিস্টিরিয়ার প্রধান লক্ষণগুলো হলো-

শরীরে খিচুনী হওয়া, স্পর্শ এবং ব্যথার অনুভূতি হারিয়ে ফেলা। শরীর ও মাংসপেশীতে আড়ষ্টভাব এবং অন্যান্য অঙ্গে অসাড়তা অনুভব। শরীরে সূঁচ ফোটানোর মতো যন্ত্রণা অনুভব। ঢোক গিলতে সমস্যা; গলায় কোনোকিছু আটকে আছে বলে মনে হওয়া।
বার বার জ্ঞান হারানো, ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন, যেমন একটি বস্তুকে দুটি দেখা। সাময়িকভাবে বাকশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলা ।

ঘন ঘন চোখের পলক পড়া। দাঁতে দাত লেগে যাওয়া। জোর করে চোখ বন্ধ কিংবা ঘাড় বাঁকা করে থাকা। বমি করা বা বারবার বমির চেষ্টা করা। শ্বাসকষ্ট, অস্থিতিশীল হৃদস্পন্দন এবং বুক ধড়ফড় করা। মানসিক অস্থিরতা অনুভব; নিজের কাজ ও আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। ঢেউয়ের মতো হাত নাড়াতে নাড়াতে দেহে ঝাঁকুনি দিয়ে হাঁটা, যাতে মনে হয় এই বুঝি পড়ে যাবে। পড়ে গেলে এমনভাবে পড়ে যাওয়া, যাতে দেহে কোনো আঘাত না লাগে।হিস্টিরিয়া রোগীদের ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, রোগের লক্ষণগুলো নিয়ে অন্যদের মধ্যে যতই উদ্বেগ থাকুক না কেন, রোগী নিজে খুব একটা বিচলিত থাকেন না। এই বিকারহীন মনোভাবকে বলা হয় la bella indefference।

রোগনির্ণয়: রোগীর বিশদ ইতিহাস পর্যালোচনা। বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা (ইসিজি)। চিকিৎসা এবং করণীয় বিভিন্ন উপায়ে হিস্টিরিয়া নিরাময় অথবা এর লক্ষণগুলো প্রশমন করা সম্ভব। এগুলো হলো-

অক্যুপেশনাল বা ফিজিক্যাল থেরাপি: কাউন্সেলিং, হিপনোথেরাপি, ইলেক্ট্রো কনভালসিভ থেরাপি সেই সাথে চিকিৎসার সময় কিছু বিষয়ের ওপর রোগীর পরিবার ও চিকিৎসকের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এগুলো হলো- রোগীকে কোনোভাবেই ঘুমাতে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে মাথায় হালকা থাপ্পড় বা টোকা মেরে, শব্দ করে অথবা কথা বলে জাগিয়ে রাখতে হবে।থেরাপির সময় রোগীর অবচেতন মনের দুঃখ-কষ্ট বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বের হয়ে আসতে থাকে। এটা সবার কাছে প্রকাশ করা যাবে না।

রোগীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে লিখে রাখতে হবে। নারী রোগীদের চিকিৎসার সময় সাথে মহিলা এটেনডেন্ট অবশ্যই রাখতে হবে। রোগীর প্রাথমিক ও হিস্টেরিক অর্জন যাতে পূরণ না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন- শ্বাসকষ্টে রোগীকে অক্সিজেন, প্যারালাইজড রোগীকে হুইলচেয়ার দেয়া যাবে না কোনোভাবেই, তাহলে রোগ স্থায়ী রূপ নেবে।