বিশ্বকাপ ছাপিয়ে এখন আলোচনায় ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট কলিন্ডা গ্রেবার। মাঠে প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি, ড্রেসিংরুমে খেলোযাড়দের সঙ্গে আলিঙ্গন, তাঁর বয়স এবং সৌন্দর্য এসব নিয়ে স্থূল আলোচনা এখন সরগরম। অনেকে নেট-ইউটিউব ঘেঁটে তাঁর বিকিনি পরা ছবির তল্লাশ করে মরছেন।
কিছু মানুষের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তারা তেঁতুল থিউরির সমর্থক। কেউ কেউ স্বপ্নে নিজেকে আবিষ্কার করছেন ক্রোয়েশিয়ার ড্রেসিং রুমে। এই আদিরসপ্রিয় শ্রেণির বাইরে কেউ কেউ আবার প্রেসিডেন্টের গ্ল্যামারাস ও বেপর্দা উপস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নাউজু বিল্লাহ নাউজু বিল্লাহ বলছেন। এদের আলোচনায় খেলা নিয়ে কথা নেই। ক্রোয়েশিয়া দেশ ও ক্রোয়াট জাতি নিয়েও কোনো প্রসঙ্গ নেই।
প্রেসিডেন্টঙঙআমাদের রুচি যে কত নিম্ন, আমাদের শিক্ষা যে কত দীন, এটা তারই প্রমাণ। আমরা যারা তাহজীব-তমুদ্দুনের মাপে তাঁকে বিচার করছি তাঁরা ভুলে যাচ্ছি বিশ্বের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ডাইভার্সিটির দিকটি। তারা ভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ধারণ করেন। সেখানে বিকিনি পরা কিংবা গ্লামার প্রদর্শন অপরাধ নয়।
তারা এসবকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। কোনো বিকিনি পরা নারীর দিকে তাকিয়ে পশ্চিমা দেশে মানুষের জিহ্বায় আমাদের মতো লালা ঝরে না। ইসলাম ধর্মে যে দু-একটি খেলা সমর্থিত তার মধ্যে ফুটবল নেই। খেলা দেখানোর সময় যদি ক্যামেরা ঘনঘন রমণীমুখি হয় তাহলে তো সেটা আরও বেশি না জায়েজ। তার চেয়েও বেশি না জায়েজ পরস্ত্রী সম্পর্কে আদিরসাত্মক আলোচনা করা।
আমাদের মধ্যে তথাকথিত সাধারণশিক্ষিত মানুষের বিকৃত রুচি প্রকাশ পাচ্ছে এ প্রসঙ্গে। তাদের জন্যে শুধু বলতে চাই, গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কী ? ঐ ভদ্রমহিলা একজনের স্ত্রী, একাধিক সন্তানের জননী।
ক্রোয়েশিয়া দেশটি বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়েও ছোট। জনসংখ্যা ৪২ লাখের মতো। ১৯৯১ সালে যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে তার জন্ম। এরপর রক্তক্ষয়ী বল্কান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। যুগোশ্লাভ ফেডারেশনভুক্ত দেশগুলোর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। প্রাকৃতিক সম্পদ আহামরি কিছু নেই, নেই বড় কোনো শিল্পও। তারপরেও স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনেই ক্রোয়াটরা দেশকে সুন্দর করে সাজিয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করতে সময় নেয়নি তারা। আইএমএফ-এর বিচারে ক্রোয়েশিয়া উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত। কোনো অজুহাতে তারা পেছনে পড়ে থাকতে চায়নি। স্বাধীন সত্তার গর্ব তারা ক্রীড়া ক্ষেত্রে তুলে ধরেছে। বিশ্বকাপ ছুঁযে দেখা থেকে মাত্র এক-পা দূরে তারা।
ক্রোয়েশিয়ানরা কতটা উদ্যমী, কতখানি যৌবনময় এবং শিক্ষিত তার প্রমাণ তাদের প্রেসিডেন্ট। মাত্র ৪৬ বছর বয়সের একজন নারীকে তারা প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। সেই নারী কেবল যৌবনদীপ্ত ও সুন্দরী নন, অসম্ভব মেধাবী। ক্যাম্ব্রিজ, জন হপকিন্সসহ বিশ্বের নামকরা ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি আছে তাঁর। এর কোনোটাই সম্মানসূচক বা তোয়াজ-তদবিরে পাওয়া নয়। আমি ক্রোয়াট প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখে হাসতে হাসেত মরতে বসেছিলাম।
তিনি বিদেশ সফরে গেছেন। প্রেসিডেন্ট সারিবদ্ধ অভ্যর্থক, যাদের প্রায় সবাই পুরুষ, তাদের সাথে হাত মিলাচ্ছেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এর মধ্যে একজন অভ্যর্থক একটু খাটো গোছের। হাত মিলানোর পর মাথা তুলে তিনি ক্রোয়াট প্রেসিডেন্টের দিকে তাকানো মাত্র মনে হলো তার মাথা ঘুরছে, গলা যাচ্ছে শুকিয়ে। পরাক্রমশালী পুতিনকে তাঁর পাশে পুতের মতেই লাগে।
বিশ্বকাপ জিতুক বা না জিতুক ক্রোয়েশিয়া জিতে নিয়েছে বিশ্বের মন। আর এ জয়ে তাদের প্রেসিডেন্টের ভূমিকা কম নয়। এমন একজনকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্যে ক্রোয়াটদের স্যালুট জানাই। তাদের কাছ থেকে দেশগঠন, সততা, শৃঙ্খলা এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষণীয় আছে অনেক কিছু। কিন্তু আমরা কোনো শিক্ষা নিতে রাজি আছি এমনটা ভাবতে পারি না। কার আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, আমরা অতীতচারী, বার্ধক্য এবং কলহপ্রিয়ই থেকে যাবো।
আজ আবার গ্যালারিতে দেখা যাবে গ্ল্যামারাস প্রেসিডেন্টকে। ক্রোয়েশিয়া যদি বিশ্বকাপ জিতে ফেলে তাহলে আনন্দের আতিশয্যে তিনি হয়তো উর্ধ্বাঙ্গবসনকেই মেলে ধরবেন গর্বিত ক্রোয়াট পতাকারূপে। আনন্দের অনুষঙ্গকে নির্মল আনন্দের মেজাজেই আমরা দেখব। আমরা মনে রাখব, ‘গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কী?’ আমার এক প্রিয় সহকর্মী এই চরণটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন….দয়াল বাবা কলা খাবা………….