চাষিদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে ভাসমান সবজি চাষ

বর্ষা মৌসুমে জেলার নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বিলের ভাসমান শাকসবজি চাষ এলাকায় এখন আশীর্বাদ হয়ে চাষিদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।

চাষের জন্য মৌসুমের শুরুর আবহাওয়া বেশ উপযোগী হওয়ায় ‘ধাপে ধাপে’ নানা শাকসবজি চারার সমারোহ এক মনোহর দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়েছে। ক্ষেত থেকে সদ্যজাত লাউ চারার বিপনন চলছে সরাসরি কৃষকের হাত থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে। প্রতিটি চারা বিক্রি হচ্ছে চার টাকা দরে। চারা গুলো যেমন তরতাজা তেমনি ডাঁগরও।

কৃষক আক্তার হোসেন (৫০) জানান, এক সপ্তাহ ধরে লাউয়ের চারা বিক্রি শুরু হয়েছে। গত বারের চেয়ে দাম বেশি। কারণ চাষের উপকরণ খরচসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। গত বছর সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকায় এক রশি (১২০ ফুট দীর্ঘ পাঁচ ফুট প্রস্থ) যে ধাপ (চারা উৎপাদনের ভাসমান বীজতলা) চাষীরা কিনেছিলেন তা এ বছর কিনতে হয়েছে সাড়ে আট থেকে নয় হাজার টাকায়।
বৈঠাকাটা গ্রামের ফেরদৌস (৩৩), মোস্তফা (৩৫), রুহুল আমীনসহ (৪১) কয়েকজন ধাপ চাষী জানান, লাউয়ের চারার চাহিদা শুরু হয়েছে। সামনে মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, করলা, বেগুন, মরমা (শশা বিশেষ) ইত্যাদি সবজি চারা চাহিদা বাড়বে এবং ধাপের চাষ শুরু হবে এক মাস পর। বৈঠাকাটা অঞ্চলের ভাসমান শাকসবজি বিশ্বের কৃষি ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ পদ্ধতি নিয়ে আগ্রহ ব্যাপক। হাওর অঞ্চল, ভবদহসহ যশোর-খুলনার বিলাঞ্চল কাপ্তাই হ্রদ, চাঁদপুরের মেঘনার চর ইত্যাদি এলাকায় ভাসমান শাকসবজি চাষের নতুন এলাকা সম্প্রসারিত হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষি বিভাগের মাধ্যমে এই চাষ পদ্ধতি ব্যাপকভাবে চালুর কাজ শুরু করেছে। বিশেষত ভাসমান শাকসবজি চাষের আদি এলাকা হিসাবে পরিচিত গোপালগঞ্জের চাঁন্দার বিল, বাইগ্গার বিল, বর্ণিবিল, টুঙ্গীপাড়া ইত্যাদি এলাকায় গত ১০ বছরে এই চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
দক্ষিণের বিল এলাকা বৈঠাকাটা-বিশারকান্দি বিল শতবর্ষ ধরে এ চাষে কৃষক নিজেরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এ বিলের মুগারঝোর, বেলুয়া মুগারঝোর, চিতলী, উমরেরপাড়, চামি এ সব গ্রামের ধাপ চাষীরা এখন মহাব্যস্ত। পিরোজপুরের জেলার নাজিরপুর উপজেলার বৈঠাকাটা বাজার কেন্দ্রিক বিল ও জলাভূমির এমন অনেক গ্রামে ভাসমান বীজতলায় শাকসবজির চারা উৎপাদনে মৌসুমী কৃষির স্বউদ্ভাবিত এ ধরণ শুধু অনন্যই নয় অবাক-বিস্ময়ও। দেশের বিরল এ চাষ পদ্ধতি বর্ষাকাল ও শরৎকাল জুড়ে অর্ধশতাব্দীকাল ধরে এ বিলাঞ্চলে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় কৃষি কৌশল। যে পদ্ধতি স্থানীয়ভাবে ধাপ বা দল চাষ নামে পরিচিত। বর্তমানে জলমগ্ন বিস্তীর্ণ ভূমির মাঝে চোখ জুড়ানো-মনভোলানো সবুজের সমারোহে নানা জাতের শাকসবজি চারার বীজতলা ভাসছে সারিতে সারিতে। ভরা বর্ষায় বিলে পানি বৃদ্ধির সাথে বাড়তে থাকে এ চাষের নানা প্রস্তুতিও। আষাঢ়ে ধাপচাষীরা নেমে পড়েন বীজতলা তৈরির কাজে, যা আরও একমাস আগে শুরু করেছেন তারা পুরোদমে।

এলাকার প্রবীন ধাপচাষীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত শতাব্দীর শুরুতে এ জলাভূমিতে যখন জনবসতির সূচনা হয় তখন থেকেই জীবন ধারণের তাগিদে এ স্বউদ্ভাবিত চাষ পদ্ধতির গোড়া পত্তন। বিলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘর বাড়ির বাসিন্দারা প্রায় সারা বছর ধরে জলমগ্ন জমিতে কোন ধরণের কৃষির সুযোগ না পেয়ে এ চাষ আরম্ভ করেন নিজস্ব মেধা-মনন খাটিয়ে।
মুগারঝোরের প্রবীন ধাপচাষী আলাউদ্দিন গাউস (৭৩) বলেন, তার বাবা-চাচারা অনোন্যোপায় হয়ে ধানের খড়, দুলালী লতাসহ নানা উদ্ভিদ, কচুরিপানা, টোপা পানার মত জলজ লতাপাতার আধাপচা দ্রব্যাদির সমন্বয়ে ধাপ বানিয়ে সেখানে শাকসবজি ফলাতে শুরু করেন। যা পরে ব্যাপকভাবে চারা উৎপাদনের বাণিজ্যিক রূপ নেয়। লাউ, করলা, মরমা (শসা প্রজাতির), কুমড়া, পুঁই, মরিচ, বেগুন, সিম, পেঁপেঁ, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম ইত্যাদির চারা ফলানো হয় ধাপে। বীজঅংকুরোদ্গম থেকে চারা বিক্রি উপযোগী হতে চার সপ্তাহ সময় লাগে।

আকতার হোসেন (৫১) ছোটবেলা থেকে পারিবারিকভাবে এ চাষের একজন সহযোগী হিসাবে এখন সক্ষম ধাপচাষীতে পরিণত হয়েছেন। তিনি জানালেন, বৈঠাকাটা বিলাঞ্চলের মনোহরপুর, পদ্মডুবি, বিলডুমরিয়া, উত্তর গাওখালী, উত্তর কলারদোয়ানিয়া, গগন, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, পশ্চিম মলুহার গ্রামেও চলছে ধাপচাষের ব্যস্ত সময়। এক মাস আগে শুরু হওয়া এ কৃষির নানা প্রক্রিয়ার ধাপবাঁধা, বীজের অঙ্কুরোদ্গম ও ধাপে প্রতিস্থাপন, পরিচর্যা, বিপনন ইত্যাদি কাজে চাষীরা দম ফেলার ফুসরতও পাচ্ছেন না। আগামী এক মাসের মধ্যে বিক্রি উপযোগী লাখ লাখ চারা ক্ষেতে প্রস্তুত করতে তাদের এই প্রচেষ্টা। এ চারা শীত মৌসুমের আগেই দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকদের ক্ষেতে শাক সবজি উৎপাদনে হাজার হাজার একর জমিতে ব্যবহৃত হবে।
ধাপচাষ নামের এই কৃষি পদ্ধতিটি আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক পর্যন্ত পাঁচ মাসের অত্যন্ত অর্থকরী ও লাভজনক কৃষি। আষাঢ়ে এসব গ্রামের নিচু জমি পানিতে প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা নেমে পড়েন এ চাষে। কচুরিপানা, ধানের খড়, দুলালী লতা, চুনা লতা, শ্যাওলা, টেপাপানা, গুড়িপানা, নারিকেলের ছোবরার গুড়া ইত্যাদি নানা জলজ ও মাটির উদ্ভিদ স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ধাপ। যা পঁচে তৈরি হয় জৈব সার। সর্বোচ্চ ১২০ ফুট লম্বা, ৫/৬ ফুট চওড়া ও এক ফুট পুরু বীজতলা বা ধাপ পানিতেই তৈরি হয়, যা থাকে ভাসমান। যার উপরে বিভিন্ন শাক-সব্জি ও চারা উৎপাদিত হয়।