আমের ব্যাপক উত্পাদন হলেও দাম পাচ্ছে না চাষিরা

বড় কোনো ঝড় কিংবা বৃষ্টিও হয়নি। আমের মুকুলের জন্য ক্ষতিকর কুয়াশার প্রকোপও তেমন দেখা যায়নি। সবমিলিয়ে এবার আম উত্পাদনের জন্য ছিল অনুকূল আবহাওয়া। ফলে এ বছর আমের ব্যাপক উত্পাদন হয়েছে। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে চাষি আম উত্পাদন করেছে তা পূরণ হচ্ছে না। দাম না পাওয়ায় চাষি, ব্যবসায়ী সবার মাথায় হাত। মৌসুমের শুরুতে গোপালভোগ আমের দাম কিছুটা পেলেও এখন ক্রেতা নেই। এতে আম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন চাষি, বাগান মালিক ও আড়তদাররা। গত মৌসুমের অর্ধেক দামও মিলছে না। পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে এসব আম।

আমের রাজধানী নামে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে আম চাষিদের এ দুর্দশার কথা জানা গেছে।

প্রতি বছর জুন মাস আম কেনাবেচার ভরা মৌসুম হলেও এবার চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। জুন পেরিয়ে জুলাইর প্রথম সপ্তাহেও জমে উঠেনি উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর আমের রাজধানী নামে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কানসাট আমের বাজার। গতকাল সোমবার সরজমিনে আমের বৃহত্তর কানসাট বাজারসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর, গোমস্তাপুর, ভোলাহাট, রহনপুরসহ বিভিন্ন আমের বাজার ঘুরে ও শিবগঞ্জ উপজেলার প্রত্যান্তঞ্চলে আম চাষিদের সাথে আলাপ করে আম বাজার সম্পর্কে এক হতাশাজনক চিত্র পাওয়া গেছে।

কানসাট বাজারে আম বিক্রি করতে আসা মনাকষা ইউনিয়নাধীন চৌকা গ্রামের আম ব্যবসায়ী স্বাধীন কুমার সিংহ জানান, আমরা ৪ জন মিলে বিভিন্ন জাতের প্রায় ২ হাজার মণ আম (গাছে থাকা অবস্থায় অনুমানের ভিত্তিতে) কিনেছিলাম। তার মধ্যে প্রায় ১ হাজার মণ বিক্রি করা হয়েছে। তাতে লোকসানের পাহাড় জমেছে। কারণ ভাটিতে ভারী বর্ষণের কারণে বড় বড় মোকামের মালিকরা আম না কেনায় এখন পর্যন্ত আমের দর বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তিনি জানান, সব খরচ ধরে মণ প্রতি লখনা আম কেনা পড়েছে ১২০০ টাকা, বিক্রি করছি ৮০০ টাকা, ফজলি আম কেনা ছিল ১৫০০ টাকা, বিক্রি করছি ৯০০ টাকা, খিরসাপাত কেনা ছিল ১৫০০ টাকা, বিক্রি করছি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, মোহন ভোগ কেনা ছিল ১ হাজার টাকা, বিক্রি করছি ৬০০ টাকা, কবুতর গুঠি কেনা ছিল ১ হাজার টাকা, বিক্রি করছি ৮০০ টাকা, কালীভোগ কেনা ছিল ১০০০ টাকা, বিক্রি করছি ৬০০ টাকা, বাতাসা আম কেনা আছে ১০০০ টাকা, বিক্রি করছি ৬০০ টাকা, বুনিয়া গুঠি আম কেনা আছে ৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা দরে। স্বাধীন কুমার সিংহ আরো জানান, আমার মতো প্রায় ৫ হাজার ব্যবসায়ীর মাথায় হাত উঠেছে।

শিবগঞ্জের আম ব্যবসায়ী রুবেল জানান, ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান হয়। কিন্তু এ বছরের মতো ব্যবসায়ী জীবনে আর কোনো বছর আসেনি। তিনি জানান, আমরা ৭ জন মিলে প্রায় ১০ হাজার মণ আম কিনেছিলাম। প্রতি বছর ভাগে প্রায় ৩ লাখ টাকা করে লাভ পেতাম। এবার লাভ তো দূরের কথা নিজের জমিজমা বিক্রি করে বাগানওয়ালাকে টাকা পরিশোধ করতে হবে।

কানসাট বাজারের আড়তদার সুমন জানান, আমার আড়ত থেকে এবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ২ থেকে ৩ ট্রাক আম পাঠাছি। যা অন্যান্য বারের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

রংপুরেও আমের বাজারেও একই অবস্থা। এখানকার বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আমের খ্যাতি দেশজুড়ে। রংপুরের শত শত মানুষ এই আম চাষ করে স্বাবলম্বী হলেও এবার এই আমের বাজারে ধস নেমেছে। রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ১ নং খোড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ, পাইকারেরহাট, শুকরেরহাট, রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়ার হাটসহ জেলা বিভিন্ন উপজেলার পাইকারি হাট, বাজার ও আড়তে বড় আকারের প্রতি মণ হাড়িভাঙ্গা ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, মাঝারি সাইজ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং ছোট আকারের হাড়িভাঙ্গা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কিন্তু কেন এ অবস্থা? সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ে এবার রাজশাহী অঞ্চলের আম পাকেনি। কারণ আম পাকার জন্য যে তাপমাত্রার প্রয়োজন, ২০ মে থেকে ১০ জুন রাজশাহীতে তা ছিল না। ফলে কমসংখ্যক চাষিই ওই সময়ে গাছ থেকে আম নামাতে পেরেছেন। এরপর ১০ জুন থেকে রাজশাহী অঞ্চলে তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এক সপ্তাহ ধরে ৩৫-৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা ওঠানামা করে। প্রচণ্ড গরম পড়ায় গাছেই আম পাকতে শুরু করে।

এদিকে রমজানের শেষের দিকে সাধারণ মানুষ ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকায় আমের চাহিদা কম ছিল। এ ছাড়া, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে পরিবহন সংকট, কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধ থাকায় চাষি আম বিক্রি করতে পারেননি। আর এখন চাহিদার তুলনায় বাজারে আমের সরবরাহ এত বেশি যে দাম পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, উত্পাদন বেশি হওয়ায় প্রথম দিকে আমের বাজার কিছুটা খারাপ হলেও ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে।

আম ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা জানান, আমের বাজারে এভাবে ধস নামলে চাষিরা আম চাষ না করে অন্য ফসলে যাবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আম উত্পাদনের জেলাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের জুস তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হলে একদিকে যেমন আমের বাজার স্থায়ীভাবে চাঙ্গা হবে, অন্যদিকে বেকার সমস্যার সমাধান হবে।

এ দিকে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, ধারাবাহিকভাবে আমের উত্পাদন বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিকভাবে আম উত্পাদনে শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে বৈশ্বিক আম উত্পাদনে নবম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে আম উত্পাদনে চাষিকে ধরে রাখতে হলে নায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই বলে মনে করেন সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক।