8 মারুফ রহমান
সোনালী খান, টাঙ্গাইল জেলা সদরের হিজড়াদের একাংশের সরদার। ছোটবেলায় সে বাবা-মায়ের সাথেই থাকতো। স্কুলে যেত, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতো, খুব সুন্দর একটি পরিবার ছিল তার। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সোনালীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। সন্তান হিজড়া এটা তার মা মেনে নিয়েছিল, কিন্তু তার বাবা ও সমাজ মেনে নেয়নি। সোনালীর বাবা সন্তান হিজড়া হয়েছে বলে তার মাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় বিয়ে করে চলে গিয়েছিল। আর তখন থেকেই শুরু হয় সোনালীর অনিশ্চিত যাত্রা। শৈশবের রঙিন স্বপ্নগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে যায় তার, চরম বাস্তবতা গ্রাস করে তাকে। উপায় না পেয়ে সোনালী অন্যান্য হিজড়াদের সাথে পথে নামে, মায়ের দায়িত্ব নেয়। সোনালীর বর্তমান সরদারের নাম জেরিন। তাদের দলে মোট হিজড়ার সংখ্যা ৩০ জন। শহরের একটি ঘিঞ্জি এলাকায় তারা বাসা ভাড়া করে থাকে। উপার্জনের একমাত্র পথ মানুষের কাছে হাতপাতা। আর এজন্য তারা সাধারণ মানুষদের বিনোদনও দিয়ে থাকে। যেটাকে আমরা সুশীল সমাজের অনেকেই পছন্দ করি না। আমরা সুশীল সমাজ একজন ভিক্ষুকে টাকা দেই, কিন্তু হিজড়াদের স্বাভাবিকভাবে টাকা দিতে কুণ্ঠিতবোধ করি। হিজড়াদের দাবি তাই তারা বিনোদনের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে টাকা নেয়। বিভিন্ন বিয়ে বাড়ি, সন্তান হয়েছে এমন বাড়ি, রাস্তার সাধারণ মানুষ, দোকান, বাজার সব মহলেই তারা নেচে-গেয়ে বা চেয়ে টাকা সংগ্রহ করে। আমাদের সমাজের সুবিধাবঞ্চিত একটি সম্প্রদায় হিজড়া বা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। সরকারি জরিপ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১০ হাজার হিজড়া রয়েছে। তবে বেসরকারি জরিপে তাদের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। অন্যান্য প্রতিবন্ধীরা সাধারণ মানুষের কাছে সহানুভূতিতা পেলেও এই হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজ বঞ্চনা ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে হিজড়ারা ভোটাধিকার ও ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বাস্তবে অনেকের কাছে তারা মানুষ হিসেবেও বিবেচ্য নয়। একজন পথের ভিখেরি যে সুযোগ সুবিধা পায় হিজড়ারা সেটুকু থেকেও বঞ্চিত। যেমন তাদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না, ভাড়া দিলেও তাদের মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়, অসুস্থ হলে কোনো ডাক্তারই তাদের চিকিত্সা করতে চায় না। শুধু তাই নয়, হিজরা সমাজের কেউ মারা গেলে তাদের জানাজা করার ক্ষেত্রে কোনো হুজুর তো দূরের কথা, মাটি দেওয়ার জায়গাটিও পাওয়া যায় না। এই দলের আরেকজন হিজড়ার নাম চামেলি। তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা, এ জন্য সে গর্ববোধ করে। সন্তান হিজড়া বলে সমাজের মানুষ তার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে হিজড়ার বাবা বলে ডাকে, এটা সে সহ্য করতে পারতো না। তাই বাড়ি ছেড়ে হিজড়াদের দলে চলে এসেছে। আমাদের সমাজ এই হিজড়াদেরকেও যৌন হয়রানি থেকে মুক্তি দেয় না। নিজেকে হিজড়া প্রমাণিত করার জন্য তাদের একটি মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এই টেস্টের সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়।
হিজড়া হলেও তাদের মনে মাতৃত্বের স্বাদ জাগে।—এমনই বলছিলেন এই দলের সরদার জেরিন শেখ। আর এই স্বাদ পূরণের জন্য জেরিন একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছে। তার ভাষায়, মেয়েটি যখন তাকে মা বলে ডাকে তখন সে পৃথিবীর সব দুঃখ ভুলে যায়। সে মেয়েটিকে লেখাপড়া করাচ্ছে। ভবিষ্যতে মেয়েটিকে যেন কেউ হিজড়ার সন্তান বলে উপেক্ষিত না করতে পারে সেজন্য তাকে নিজের বাবা-মায়ের কাছে রেখে মানুষ করছে জেরিন। তারা মানুষের কাছ থেকে যে উপায়ে টাকা নেয় এতে সাধারণ মানুষ বিরক্তবোধ করে এটা জেরিন জানে। তবে তার কথা হচ্ছে, ‘আজ আমার দলে ৩০ জন হিজড়া আছে, তাদেরকে আমার চালাতে হয়। কেউ আমাদের কাজ দেয় না, সমাজ আমাদের মানে না। সরকার প্রতিমাসে আমাদের জন্য যে ৭শ’ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করেছে, তা আমরা কেউ পাই না।’