নারীর সন্তান ধারণ ও লালনপালনের সকল গুরুত্বকে ছাপিয়ে পিতৃত্বের দখলদারিত্ব ও অধিকারবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। ফলাফলস্বরূপ মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় সন্তানের জিম্মাদারিত্ব তথা সন্তানকে কাছে রেখে লালনপালন করার মা ও শিশুর জন্মগত ও ন্যায্য অধিকারকে। সামাজিকভাবে ধরেই নেওয়া হয়, পিতাই সন্তানের চূড়ান্ত অধিকারী
আসমা খানম রুবা
সন্তান জন্মদান থেকে লালনপালনে নারীর গুরুত্ব যে অপরিসীম তা কোনোভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবু যখন বিয়ে নামক সমাজের আদি প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, তখন নারীর সন্তান ধারণ ও লালনপালনের সকল গুরুত্বকে ছাপিয়ে পিতৃত্বের দখলদারিত্ব ও অধিকারবোধ প্রবল হয়ে ওঠে। ফলাফলস্বরূপ মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় সন্তানের জিম্মাদারিত্ব তথা সন্তানকে কাছে রেখে লালনপালন করার মা ও শিশুর জন্মগত ও ন্যায্য অধিকারকে। সামাজিকভাবে ধরেই নেওয়া হয়, পিতাই সন্তানের চূড়ান্ত অধিকারী। আর তাই সন্তানের মায়ের সঙ্গে বাবার বিরোধ উপস্থিত হলে সন্তানকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বাবার দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অতীত থেকে চলে এসেছে অদ্যাবধি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর আইন সহায়তা কার্যক্রমের পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতিবছরে সন্তানের জিম্মাদারিত্ব, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ এবং জোরপূর্বক বাবা বা বাবার আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক নাবালক সন্তান, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে মায়ের সাহচর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটক রাখার সংখ্যা নিতান্ত কম নয় বরং আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
২০১৭ সালে আসক আইন সহায়তা কার্যক্রমে নাবালক সন্তানের জিম্মা সংক্রান্ত ২৭টি অভিযোগ নিবন্ধিত করা হয়। যার মধ্যে দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ অন্যান্য শিশুকে বাবার বেআইনি আটক থেকে আদালতের মাধ্যমে উদ্ধার করে মায়ের জিম্মায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সালিশের মাধ্যমে ২৫ জন শিশুকে মায়ের জিম্মায় বসবাসরত অবস্থায় বাবার কাছ থেকে নিয়মিতভাবে ভরণপোষণ আদায় করে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মায়ের জিম্মায় থাকা পাঁচজন শিশুসন্তানকে আসক কার্যালয়ে নিয়মিতভাবে বাবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর বিধান অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়স্ক সন্তানকে নাবালক বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আর অভিভাবক হলেন তিনি, যিনি কোনো নাবালকের শরীর অথবা সম্পত্তি অথবা সম্পত্তি ও শরীর উভয়ের তত্ত্বাবধানের এবং ভরণপোষণ প্রদানে আইনগতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।
উক্ত আইন অনুযায়ী নাবালকের স্বাভাবিক এবং আইনগত অভিভাবক হলেন পিতা। পিতার অনুপস্থিতিতে বা অভিভাবক হিসেবে অযোগ্যতায় মাতা অথবা আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োজিত ব্যক্তি নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারেন। তবে নাবালকের সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের গুরুত্বের ওপরে ভিত্তি করে তার জিম্মাদারিত্বের বিষয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী সন্তানের মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুকে সাত বছর এবং মেয়েশিশুকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মা তার জিম্মায় রাখার অধিকারী। তবে মা বা নাবালক সন্তান যার তত্ত্বাবধানেই থাকুক না কেন সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া, দেখাশোনা করা এবং ভরণপোষণ দেবার দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে সন্তানের পিতার। সন্তানের জিম্মাদারিত্বের নির্দিষ্ট বয়স পার হলেই যে সন্তান বাবার জিম্মায় যেতে বাধ্য হবে তা নয়, নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম করার পরেও সন্তানের সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে সন্তানের জিম্মাদারিত্বের দায় পুনরায় মায়ের নিকট ন্যস্ত হতে পারে। সার্বিক কল্যাণ বলতে আইন অনুযায়ী সন্তানের পার্থিব, নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক কল্যাণকে বোঝানো হয়ে থাকে। যা শিশুটির নিরাপত্তার পাশাপাশি সুন্দর ও উত্তমরূপে প্রতিপালনের বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করে। জিম্মাদারিত্বের নির্দিষ্ট বয়স পার হলেই পিতা শর্তহীনভাবে বাচ্চাদের চূড়ান্ত জিম্মাদার হতে পারেন না, এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্তানের সার্বিক কল্যাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মায়ের জিম্মায় সন্তান থাকা অবস্থায় বাবা যদি কোনো ভরণপোষণ না দেন, সে ক্ষেত্রে মা সন্তানকে পিতার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ করাতে বাধ্য নন বলে বিভিন্ন মামলার রায়ে অভিমত প্রদান করা হয়েছে (১৭ ডিএলআর ১৩৪)।
অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯ ধারায় অভিভাবক হিসেবে পিতাও অযোগ্য হতে পারেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বাবা চারিত্রিকভাবে অসত্ হন, সন্তানের মা অর্থাত্ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতা করেন, মাদকাসক্ত এবং অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি থাকে, বাবা পুনরায় বিয়ে করেন এবং নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করেন। অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব হলো প্রতিপাল্য অর্থাত্ নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য সকল ব্যাপারে নৈতিক এবং অর্থনৈতিক সকল সুবিধা প্রদান করা। সাধারণত প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে যে, মা পুনরায় বিয়ে করলে নাবালক সন্তানের জিম্মার অধিকার হারান। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে আদালত সব ঘটনা ও অবস্থা বিবেচনা করে নাবালককে তার মায়ের পুনর্বিবাহের পরেও জিম্মায় রাখার আদেশ দিতে পারেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামী-সন্তানকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সে পরিস্থিতিতে স্ত্রী নাবালক শিশু এমনকি সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেও জিম্মার আবেদন জানালে আদালত সন্তানের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্তানের জিম্মা মাকে দিতে পারেন।
অভিভাবকত্ব এবং নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের জন্য পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। এ ছাড়া আদালতের বাইরে উভয় পক্ষ সমঝোতার মাধ্যমে বা কারো মধ্যস্থতায়ও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। আদালতের মাধ্যমে প্রতিপাল্যের বিষয়ে কোনো আদেশ প্রদান করা হয়ে থাকলে যদি কেউ আদালতের এখতিয়ারের সীমা থেকে নাবালককে সরিয়ে নেয়, তাহলে আদালতের আদেশে ওই ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ১ হাজার টাকার জরিমানা অথবা ছয় মাস পর্যন্ত দেওয়ানি কারাবাস ভোগ করতে বাধ্য থাকবে। ওই দেওয়ানি কারাবাসের খরচসহ মামলার খরচ এই আইনের মোতাবেক হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রণীত কোনো বিধি সাপেক্ষে যে আদালতে মামলাটি চলছে তার বিবেচনার ওপর নির্ভর করে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।