বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে দুইজন গণমাধ্যম কর্মীর প্রশ্নকে ‘অর্থহীন’ উল্লেখ করে ক্ষিপ্ত হয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এক পর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, এগুলো কোনো প্রশ্নই না। আর এসব নিয়ে কথা বলতে তার লজ্জা লাগে।
বৃহস্পতিবার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। রীতি অনুযায়ী পরদিন গণমাধ্যমকর্মীদের মুখোমুখি হন তিনি। এ সময় থাকে সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ও নীতি নির্ধারকরা।
এই আয়োজনে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মশিউর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রারম্ভিক বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এবার আপনারা যত খুশি প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা উত্তর দেব।’
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন তিনটি বিষয়ে। ১. সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়েছেন কার চাপে। ২. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোনো উপহার আছে কি না, ৩. রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব কি না।
অর্থমন্ত্রী এই তিনটি প্রশ্নেরই জবাব দেন শান্তভাবে। বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না। এটি সময় সময় পর্যালোচনা হয়। বাজেটের পরও হবে।
আর সরকারি চাকুরেদের জন্য নতুন কিছু নাই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এই সরকার তাদেরকে যা দিয়েছে, এরপর আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না।আর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রতি বছর এমন প্রশ্ন আসে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কিছু অপূর্ণ থাকলেও এটি কম বেশি পূরণ হয়। আবার আগামী অর্থবছরেও পূরণ হবে।
পরে অন্য একজন সাংবাদিক বলেন, ‘আপনি তেলা মাথায় তেল দেয়া শুরু করে দিয়েছেন। ব্যাংকের সিআরআর কমিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারি ফান্ড ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ করেছেন। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানদের আয়কর ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৭.৫ শতাংশ করেছেন, এটা কী ধরনের আচরণ জানি না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, করপোরেট করের উচ্চতম হার ৪০ থেকে কমিয়ে তিনি ৩৭.৫ এ নিয়ে এসেছেন। এর কারণ, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ৪০ এর বেশি করপোরেট কর খুব কম দেশে আছে। আমরাও সেটা কমিয়ে এনেছেন।
করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত আকস্মিক হয়নি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এটি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রীও মত দিয়েছেন।
বাজেট নিয়ে কয়েকটি পত্রিকার সংবাদে ‘দারুণ আপত্তি’ আছে মুহিতের। বলেন, ‘মনে হয় তারা বাংলা জানেন না। তারা বলছে এটা ভুয়া বাজেট। হোয়াট ইজ দ্য মিনিং অব ভুয়া বাজেট?’
‘আই ওয়ান্ট টু আস্ক, বাজেট কী করে ভুয়া হতে পারে? এটা শুধু নির্বোধের জন্য হতে পারে। এই কমেন্ট রিপিটস অনলি দ্য নির্বোধ এক নম্বর আর দুই নম্বর যার দেশপ্রেম নেই। এই দুই ছাড়া আর কেউ ভুয়া বলতে পারে না। স্যরি।’
এর ফাঁকে এক প্রশ্নে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, অনলাইন কেনাকাটায় কোনো ভ্যাট বসেনি। এটি ছাপার ভুলে হয়েছে।
আর প্রসাধনের ওপর কর বাড়ানোর বিষয়ে রসিকতাও করেন পরিকল্পনামন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী।
মতিয়া চৌধুরী কবিতার দুই লাইন উল্লেখ করে বলেন, ‘একটু কম প্রসাধনীতে খারাপ লাগবে, এটা ঠিক না।’ এ সময় হাস্যরস পড়ে যায়।
পরে আরকেজন সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন বাজেটে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রাখার বিষয়ে। বলেন, ‘আপনি জিডিপির পাঁচ শতাংশের মধ্যে রাখবেন বলে ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ যেভাবে বাড়ছে, এবং ঋণের সুদ পরিশোধে বাজেটে যে বরাদ্দ বাড়ছে। আজ থেকে ১০ ১৫ বছর পরে সে বরাদ্দ কোথায় যাবে?’
‘দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে… ব্যাংকিং ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা এবং পুঁজিবাজারে বিশৃঙ্খলা দূর করার ক্ষেত্রে আপনি আপনার ব্যর্থতা স্বীকার করেন কি না।’
অন্য একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনি গত নয়-১০ বছর পর বলে আসছেন বৈষম্যহীন সুখী দেশ গড়ার কাজ করছেন। কিন্তু আপনি প্রস্তাবিত কর কাঠামোতে ধনীদেরকে বেশি সুবিধা দিয়েছেন এবং মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের ভ্যাটের বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
‘যাদের গাড়ি নেই তারা উবার এবং পাঠাওয়ের ওপর নির্ভর করে পরিবার পরিজন নিয়ে বাইরে বের হতে পারত। এখানেও আপনি ভ্যাট বসিয়েছেন। আমার প্রশ্ন হলো আপনি কি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নাকি আপনার এসব কার্যক্রম বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না।’
পরে আগে প্রশ্ন করা সাংবাদিক আবার উঠেন। বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, আমার তেলা মাথায় তেলে বিষয়টা ক্লিয়ার হই নাই। আপনি ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য সুবিধা দিলেন, কিন্তু তারা কি আদৌ কমিয়েছে?’
অন্য একজন সাংবাদিক বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, এই বাজেট ধনীবান্ধব বাজেট এবং গরিব মারার বাজেট। ছোট আকারের ফ্ল্যাটের নিবন্ধনে ভ্যাট বাড়িয়েছেন, বড় ফ্ল্যাটে বাড়াননি। এটা গরিব মারার বাজেট কি না।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বুঝতে পারিনি। দুঃখিত, আবার বলেন।
ওই সাংবাদিক বলেন, ‘আমার প্রশ্ন হলো যে, ১১০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়িয়েছেন, দেড় থেকে দুই শতাংশ করেছেন। আবার ১০০০ থেকে ১৬০০ স্কয়ার ফিটেও বাড়িয়েছেন। কিন্তু এর ওপরে বাড়াননি। সাধারণত ছোট আকারের ফ্ল্যাট স্বল্প আয়ের মানুষ কেনেন। কিন্তু আপনি সেদিকে নজর না দিয়ে উচ্চবিত্তকে সুবিধা দিয়েছেন।’
জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আপনারা যে প্রশ্ন করেছেন, এগুলো মিনিংলেস হয়ে যাচ্ছে। দেয়ার ইজ নো সাচ অ্য কোশ্চেন, ইটস অ্যা সিম্পল স্টেটমেন্টস অব ফলসহুডস।’
‘বাংলাদেশ এখন কী অবস্থায় আছে আপনারা জানেন? এ দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে? আনসার মি দিন কোশ্চেন এনিওয়ান। এ দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে?’
উত্তেজিত হয়ে অর্থমন্ত্রী বলতে থাকেন, ‘এ দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে না, যে বলে বাড়ছে, হি ইজ জাস্ট লাইয়িং, অফ কোর্স লাইয়িং। বৈষম্য বাড়ে নাই।’
‘আপনার এমন সব প্রশ্ন করছেন, যে আমার পক্ষে এগুলো বলতেও লজ্জাবোধ করে। এ রকম কি রকম হতে পারে একটা দেশের লোকজন, সাংবাদিকরা, এরা শিক্ষিত লোক যারা দেশের পরিবর্তন স্বীকার করে না।’
‘বাংলাদেশে এখন ২২.৪ শতাংশ লোক গরিব। আপনাদের যখন জন্ম হয়েছে বা জন্মের আগে, সেটা ছিল ৭০ শতাংশ। বোঝেন কোথায় ছিল বাংলাদেশ। কোথায় এসেছে।’
‘এই কিছুদিন আগে ৩০ শতাংশ লোক ছিল গরিব। সাত বছর আগে সাড়ে ৩০ শতাংশ। আজকে ২২.৪ শতাংশ।’
‘যারা চূড়ান্ত গরিব, তারা ছিল ১৮ শতাংশ। এখন তারা ১১ শতাংশ। কোন মুখে আপনারা বলেন এই দেশে গরিব মারার বাজেট হচ্ছে? ধনীদের তেল দেবার বাজেট হচ্ছে। দেশের উন্নয়নে বলেননি, কিন্তু বুঝাতে চাইছেন কিছুই হয়নি?’
পরে দুঃখ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘স্যরি, আই এম স্যরি ফর মেইকিং দিস স্টেটমেন্ট। বাট আই কুড নট রেজিস্ট মাইসেল্ফ। বিকজ আই থিংক ইউ আর নট এটঅল এটেন লিড ইন টু দ্য বাজেট। ইউ আর নট এট অল ক্রিসিজাইজিং দ্য বাজেট। ইউ হ্যাভ সাম সেট কোশ্চেন, ইউ হ্যাভ কাম হেয়ার টু প্রেজেন্ট দ্যাট।’
পরিকল্পনামন্ত্রী পরে ফ্লোর নিয়ে বলেন, ‘সুপ্রিয় বন্ধুগণ আপনারা আস্তে আস্তে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে নমনীয় হয়ে প্রশ্ন করবেন। আপনাদের সেসব প্রশ্নের উত্তর তিনি দেবেন।’
‘যতক্ষণ আপনারা সন্তুষ্ট না হবেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করব আপনাদেরকে সন্তুষ্ট করব।’
বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রী বনে, ‘এটা ঠিক নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে দেশে বৈষম্য কিছুটা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে বৈষম্য আমরা রাখি নাই।’
‘আমরা এটা নিয়ন্ত্রণ করি থ্রো সাম অ্যাপ্রোচ। আমাদের ইনকাম ট্যাক্স রেইট ফ্ল্যাট না। আমরা রেখেছি যারা বেশি আয় করে তাদের জন্য বেশি আয় কর, যারা কম আয় করে, তাদের জন্য কম আয়কর। আর যারা আরও কম আয় করে, তাদের জন্য কর রাখি নাই।’