টাকা ছাড়া মিলছে না বিনামূল্যের বই

২০১০ সাল থেকে সরকার সারাদেশে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদেরকে বিনামূল্যে বই দেয়। তবে বিনামূল্যের সেই বই নিতেও শিক্ষার্থীদের গুনতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। আর যারা এই টাকা দিতে ব্যর্থ হয় তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে না বিনামূল্যের বই। এমনই অভিযোগ পাওয়া গেছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সেশন ফি ও ফরম পূরণের নামে শ্রেণি অনুযায়ী প্রতি শিক্ষার্থীর কাছে থেকে বাধ্যতামূলক ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যারা টাকা দিতে পারছে না তাদের বই দেওয়া হচ্ছে না।

তবে শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ শ্রেণিভেদে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। বইয়ের জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। কিন্তু বই দেওয়ার সময় সেশন ফি অথবা ফরম পূরণের টাকা জমা দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই বলে জানান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।

বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, টাকা ছাড়া তাদের নতুন বই দেওয়া হয়নি। তাই তারা বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে বিদ্যালয় থেকে নতুন বই সংগ্রহ করেছেন।

টেপাখড়িবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহিম সরকারের মা ফারিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে নতুন বই আনার জন্য স্কুল গেলে শিক্ষকেরা তার কাছে ৭০০ টাকা দাবি করেন। পরে অনেক কষ্টে ৫০০ টাকা জোগাড় করে ছেলেকে দেই। কিন্তু ছেলে বই না নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসে। তখন বিদ্যালয়ে গিয়ে আমি জানতে পারি, বই নিতে হলে পুরো ৭০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। ২০০ টাকা বাকি রাখায় আমার ছেলেকে বই দেওয়া হয়নি। উপায় না দেখে প্রতিবেশীর কাছে চাষাবাদের শ্যালো মেশিন বিক্রি করে ছেলেকে টাকা দেই।

শিক্ষার্থী ফাহিম ঢাকা পোস্টকে বলে, আমার বাবা গত সাত মাস থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। মা স্যারদের দাবিকৃত সম্পূর্ণ টাকা দিতে না পারায় আমাকে নতুন বই দেওয়া হয়নি। পরে টাকা পরিশোধ করে নতুন বই নিয়েছি।

একই এলাকার ফরিদা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মেয়ে ময়না আক্তারকে পড়াচ্ছেন। এবার টাকা দিতে না পারায় ফরিদার মেয়ে ময়নাকেও নতুন বই দেয়নি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

ফরিদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুনেছি সরকার বই বিনামূল্যে দিচ্ছে। তাহলে আমার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে কেন? আমি স্বামী পরিত্যক্তা দিনমজুর মানুষ। দিন এনে দিন খাই। আমার মেয়েটা প্রতিবন্ধী। উপবৃত্তির টাকাও পায়নি। এত টাকা একসঙ্গে জোগাড় করা কি আমার পক্ষে সম্ভব। তাই মেয়েকে ভর্তি করাতে না পেরে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি গার্মেন্টসে কাজ খোঁজার জন্য।

স্থানীয় বাসিন্দা আমির হামজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ১ জানুয়ারি নতুন বই পেয়ে আনন্দ করেছে। আর এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক টাকা ছাড়া বই দিচ্ছেন না।

বিদ্যালয়ের সহকারী কয়েকজন শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ টাকা আদায়ের পর শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বই বিতরণ করা হয়। সেশন ফি না নিয়ে ভর্তি ও বই দিতে নিষেধ করেছেন প্রধান শিক্ষক। তার চিরকুট ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারব না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেপাখড়িবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফাতেমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ভর্তি ও সেশন ফি বাবদ ষষ্ঠ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ৫০০ টাকা এবং সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিকট ৭০০ টাকা নিয়েছি। নতুন বইয়ের জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। নির্ধারিত সেশন ফির পুরো টাকা ছাড়া বই না দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, শ্রেণি শিক্ষকরা ভর্তির দায়িত্বে আছেন। আমি বিষয়গুলো খোঁজ নিয়ে দেখব।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সরকার সকল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দিচ্ছে। সরকারি বই বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী বিতরণের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ নিয়ে থাকে, তাহলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।