চার্জ হবে তারের সংযোগ ছাড়াই!

কোনো ধরনের চার্জিং পোর্ট বা তার ছাড়া স্বয়ক্রিয়ভাবেই চার্জ দেওয়া যাবে এমন বৈদ্যুতিক যান (গাড়ি) উদ্ভাবন করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে একদল তরুণ গবেষক। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন জুবায়ের আহম্মেদ

তারের সংযোগ ছাড়াই গাড়ি হবে চার্জ
দুই বন্ধু নাহিদ ও কবিরের থিসিস থেকেই ওয়্যারলেস চার্জিং যান উদ্ভাবনের আইডিয়াটা আসে। তাঁদের থিসিস গবেষণার বিষয় অনেকটা তারবিহীন চার্জিং যান নিয়েই ছিল। এই দুজনের থিসিস সুপারভাইজর ড. ইফতে খাইরুল আমিন থিসিস/প্রজেক্টটি ফান্ডিংয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। এরপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারের অর্থায়নে এই প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যোগ হন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইইই বিভাগের আরো সাত শিক্ষার্থী।

তাঁরা হলেন—চতুর্থ বর্ষের রেজওয়ান জাকারিয়া, মো. রিফাত হোসেন, আবির মাহমুদ, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, মো. ইরফান উদ্দিন আহমেদ মেহেদী, মো. তাওসিফুল আলম ও গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী আজম জামান। এই প্রজেক্টের প্রধান ইনভেস্টিগেটর হলেন ইইই বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. ইফতে খাইরুল আমিন ও কো-ইনভেস্টিগেটর সহকারী অধ্যাপক নাফিস ইমতিয়াজ রহমান। এই দুই শিক্ষকের অধীনে ইইই বিভাগের শিক্ষার্থীদের ৯ সদস্যের দল এই প্রজেক্টে কাজ করেছেন। অতঃপর তাঁদের গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়।

তার ছাড়াই গাড়িতে চার্জ
তাঁদের গাড়িটিতে চার্জিংয়ের জন্য আলাদা কোনো তার বা পোর্ট ব্যবহার করতে হবে না। প্রচলিত পদ্ধতিতে চার্জিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট ক্যাবল, স্টেশন ও পোর্ট থাকতে হয়। কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবন বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো গাড়িতে এসব কোনো ঝামেলা নেই। তবে অবশ্যই তারবিহীন চার্জিং সেবার জন্য নির্দিষ্ট ট্রান্সমিটার থাকতে হবে।

এ ছাড়া চার্জিংয়ের সময় কতটা লাগবে তা ট্রান্সমিটার এবং রিসিভারের কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। তাঁরা জানান, বৈদ্যুতিক এই যানটি কোনো পাওয়ার স্টেশনে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হতে থাকবে। আপনি চাইলে অ্যাডাপ্টারের মাধ্যমেও চার্জ করতে পারবেন। এরই মধ্যে গাড়িটি সফলভাবে চালাতে সক্ষম হয়েছে গবেষকদলটি।

আছে নানা প্রযুক্তি
এই যানটিতে হাই-ফ্রিকুয়েন্সি ইনভাটার প্রযুক্তি, ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজিং অ্যালগরিদম, কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং, কিলোহার্টজ রেঞ্জ রেযোনেটর কাপ্পিং, ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, প্রটেকশন সার্কিট, মিস-এলাইনমেন্ট রিডাকশন টেকনিকসহ আরো অনেক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হয়েছে।

এতে রয়েছে উচ্চ ফ্রিকুয়েন্সি সংবলিত ইনভার্টার টেকনোলজি, যা ২০ কিলোহার্টজ আউটপুট দিতে পারে। রয়েছে ব্যাটারি ম্যানেজমেন্টে সিস্টেম, ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা। যানটির নিজস্ব সুরক্ষার জন্য ফিউজ ও সার্কিট ব্রেকারসহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয়েছে। গাড়িটির কার্যক্ষমতা ৪০ শতাংশের বেশি বলে জানান তাঁরা। এই যানটিতে সিকিউরিটি বা নিরাপত্তার কমতি নেই।

চৌম্বক ক্ষেত্রে চার্জ
তারবিহীন চার্জিং পদ্ধতিতে দুটি বস্তুর মধ্যে শক্তি স্থানান্তর করতে চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করা হয়। চার্জার প্যাডে একটি কয়েল থাকে, যখন এটি চার্জিং পোর্টে প্লাগ ইন করা হয় তখন একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। বৈদ্যুতিক গাড়িতে একটি রিসিভিং কয়েল থাকে, যা এই চৌম্বক ক্ষেত্রটিকে তুলে নেয়। এটি রিসিভিং কয়েলে একটি কারেন্ট প্ররোচিত করে, যা ব্যাটারিকে চার্জ করে। এই প্রযুক্তিটি শারীরিক সংযোগকারী এবং তারের প্রয়োজনীয়তা দূর করে, যার ফলে আরো সুবিধাজনক এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব চার্জিং সুবিধা পাওয়া যায়।

আছে নানা সুবিধা
তারবিহীন চার্জিং যান ব্যবহারে তারের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ থেকে বাঁচা যায়। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক শক হওয়ার সম্ভাবনা কম, বিশেষ করে বৃষ্টির মতো খারাপ আবহাওয়ার ক্ষেত্রে তারযুক্ত যানবাহন চার্জে বৈদ্যুতিক শকের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন কম্পানির জন্য তারের অ্যাডাপ্টারের বৈষম্যসংক্রান্ত সমস্যাগুলো কমে আসবে এবং ব্যবহারকারীরা গাড়িটি চার্জ করার জন্য বাইরে এসে যেকোনো পাওয়ার স্টেশনে খুব সহজেই চার্জ দিতে পারবেন। এই যানটি বাজারে কবে আসবে জানতে চাইলে দলের সদস্য জয় বলেন, ‘এই যানটির কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। যদি পর্যাপ্ত তহবিল এবং সহায়তা পাই, আমরা যত দ্রুত সম্ভব বাজারে আনার চেষ্টা করব। সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের এই উদ্ভাবন নিয়ে আরো কাজ করতে চাই। আমাদের এই যানটি পুরোপুরি বাজারে আনা গেলে তারচালিত চার্জিং গাড়িগুলো রিপ্লেস করা সম্ভব হবে। দ্রুত চার্জিং এবং দীর্ঘ দূরত্ব যেতে সক্ষম যান উপহার দিতে চাই। পাশাপাশি গাড়িটির কার্যকারিতা আরো উন্নত করার পরিকল্পনা করছি। এই যান উদ্ভাবনের ফলে ব্যবহারকারীর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।