মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের ফ্রি টিকিট দিয়ে স্বর্ণসহ বিভিন্ন মূল্যবান মালামাল বহন করাত একটি সংঘবদ্ধ চক্র। আর লাগেজ পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিমানবন্দরে আসা প্রবাসীর স্বজনদের নিজেদের জিম্মায় নিত চক্রটি। এই চক্রের সদস্যরা দেশ-বিদেশে অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল।
এক প্রবাসীর বাবাকে জিম্মি করার অভিযোগে চক্রের তিন সদস্য খোরশেদ আলম (৫২), জুয়েল রানা মজুমদার (৪০) ও মাসুম আহমেদকে (৩৫) গ্রেফতার করেছে র্যাব।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শান্তিনগর থেকে অপহৃত প্রবাসীর বাবাকে উদ্ধার ও জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, অন্যান্য মূল্যবান পণ্যসামগ্রী জব্দ করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
শুক্রবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গত ৯ অক্টোবর রাতে যশোরের চৌগাছা থেকে সৈয়দ আলী মন্ডল (৬৫) সৌদি ফেরত ছেলেকে নেওয়ার জন্য ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এসে নিখোঁজ হন। পরিবারের লোকজন সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে।
এ ছাড়াও পরিবার র্যাব-৪ এ উদ্ধারের জন্য আবেদন করে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় র্যাব-৩ এবং র্যাব-৪ এর একটি যৌথ অভিযানে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ ও অপহৃত সৈয়দ আলীকে উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা অপহরণের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
কমান্ডার মঈন বলেন, সৈয়দ আলীর ছেলে নুরুন্নবী চলতি বছরের ২০ আগস্ট উন্নত জীবন যাপনের আশায় সৌদি আরবে যান। কিন্তু সেখানে ভালো চাকরির সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় চক্রের মধ্যপ্রাচ্যের মূলহোতা আবু ইউসুফ এবং তার সহযোগীরা নুরুন্নবীর আর্থিক দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাকে বাংলাদেশে আসার ফ্রি বিমানের টিকিট দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এ জন্য চক্রের দেওয়া স্বর্ণালংকারসহ বেশকিছু দামি কসমেটিক্স পণ্য, ইলেকট্রনিকস আইটেম, চকলেটভর্তি লাগেজ দেশে নিয়ে আসতে হবে। বিমানবন্দর এসে এই লাগেজ চক্রের দেশীয় অন্যতম মূলহোতা খোরশেদ আলমের কাছে পৌঁছে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। এতে রাজি হন প্রবাসী নুরুন্নবী।
গত ৯ অক্টোবর তার দেশে আসার কথা। প্রবাসী নুরুন্নবীর বাবা সৈয়দ আলী একই তারিখ রাতে ছেলেকে রিসিভ করতে ঢাকায় আসেন। কিন্তু চক্রের সদস্যরা অভিনব কৌশলে তাকে অপহরণ করে। এরপর তারা ইউসুফের পাঠানো পণ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে সৈয়দ আলীকে জামানত হিসেবে জিম্মি করে।
গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক চক্রে ১২ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। চক্রটি একজন বিমানযাত্রীর যে পরিমাণ মালামাল বহনের সুযোগ থাকে তার সম্পূর্ণটাই তারা ব্যবহার করত। শুল্ক ফাঁকি দিতে তারা এমন কৌশলে ৫-৬ বছর ধরে এভাবে স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন পণ্য দেশে আনত।
যা দেশের মার্কেটে বিক্রি করত। চক্রটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বসবাস করে এমন এলাকাগুলোসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিত। এটা দেখে কেউ যোগাযোগ করলেই তাকে কব্জা করত তারা। তাদের দেওয়া স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রীতে পূর্ণ ২৫ থেকে ৩০ কেজির ওজনের লাগেজ দিত।
লাগেজে আনুমানিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা মূল্যের পণ্য থাকে। এ ছাড়াও যারা ফ্রি টিকিটে দেশে আসতে চান, প্রথমে তাদের পাসপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় চক্রটি। এরপর প্রবাসী বিমানে ওঠার পরে তার অজান্তেই নানান কৌশলে স্বজনদের অপহরণ করে জিম্মি করত।
এরপর প্রবাসী ব্যক্তি ঢাকায় পৌঁছানোর পর চক্রের কয়েকজন সদস্য বিমানবন্দরে উপস্থিত থেকে মালামাল বুঝে নিত। মালামাল বুঝে পাওয়ার পরই জিম্মায় থাকা ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দিত তারা।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেফতার হওয়া চক্রের সদস্যরা এসব স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান পণ্য রাজধানীর গুলিস্তান ও পল্টনসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করত।
বিদেশ থেকে নিয়ে আসা একটি লাগেজের পণ্য বাংলাদেশের বিভিন্ন মার্কেটে ১৫-২০ লাখ টাকায় বিক্রি হত। এরপর মালামালের বিক্রিত টাকার লভ্যাংশ একটি অংশ খোরশেদ নিজে রেখে বাকি একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে ইউসুফের কাছে পাঠাত।
র্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেফতার খোরশেদ ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সৌদি প্রবাসী ছিলেন। বিদেশে বসে চক্রটি গড়ে তোলেন তিনি। এরপর চলতি বছরের শুরুতে দেশে এসে চক্রের মূলহোতা হিসেবে দায়িত্ব নেন। গ্রেফতার জুয়েল শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে আসা পণ্যগুলো নিজেদের কাছে রাখতেন।
জুয়েলের গাজীপুরে সাইকেল ও রিকশার পার্টসের ব্যবসা আছে। বিদেশ থেকে আনা মালামাল বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বের করার কাজও করতেন তিনি। তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর ও ওয়ারি থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার মাসুম জুয়েলের কসমেটিক্সের দোকানে কর্মচারি হিসেবে কাজ করতো। একটা সময় গাড়িচালক ছিল সে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদক মামলা রয়েছে।