দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার অভাবেও ঘটছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড। কোনো একটি ঘটনা ঘটলেই তৎপর হয়ে উঠে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রোধে কমিটি দেয় নানা সুপারিশ। কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবাজারের ৯টি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর আবারও বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতার অভাবেই তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তাদের মতে সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসসহ জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় কেউ বিনিয়োগ করতে চান না। যে কারণে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। আর প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে হলে প্রথমেই দরকার নাগরিক সচেতনতা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রতিষ্ঠান বানাচ্ছি, মার্কেট তৈরি করছি, কিন্তু সেখানে অগ্নিঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। অগ্নিঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রক্রিয়া আমরা অনুসরণ করছি না। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময়ে আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু সরঞ্জামাদি প্রয়োজন। এর ব্যবস্থা করতে হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। বিশ্বের অগ্নিদুর্ঘটনাগুলোতে নজর দিলে দেখা যায়, নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা যেখানে ভালো সেখানে ক্ষতির পরিমাণ কম। আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তুলনামূলক ক্ষতি বেশি হয়। মানুষের জীবনও যায় বেশি।
আব্দুর রশীদ বলেন, নিরাপত্তার সঙ্গে বিনিয়োগের একটি সম্পর্ক আছে। আমাদের দেশে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থায় মানুষ বিনিয়োগ করতে চান না। এ কারণে আগুনের সূত্রপাতের পর ফায়ার ফাইটিংসংক্রান্ত সক্ষমতা তৈরি হয় না। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এত বড় মার্কেটে আগুন লাগলে তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সে বিষয়ে মার্কেট কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ছিল না। ভাগ্য ভালো যে, ভোরে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। ওই সময় সেখানে লোকজন না থাকায় সেভাবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দিনে সেখানে আগুন লাগলে লোকজনকে নিরাপদে বের করে আনার মতো ব্যবস্থাপনা মার্কেট কর্তৃপক্ষের ছিল না।
এক প্রশ্নের জবাবে এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার বিষয় আছে। আমি মনে করি, একটি দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু একটি ঘটনার পর সিরিজ অব ঘটনা শুরু হলে বোঝা যায় যে, এর ভেতরে নাশকতা কাজ করতে পারে। তাই গভীরভাবে দেখতে হবে, এর পেছনে কোনো অপশক্তি আছে কিনা। তিনি বলেন, অতীতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে তদন্ত কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে হয় না।
সাবেক আইজিপি ও রাষ্ট্রদূত ড. হাসান মাহমুদ খন্দকার যুগান্তরকে বলেন, একেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। কোথাও অসচেতনতার কারণে, কোথাও অবকাঠামোগত ত্রুটি আবার কেথাও নাশকতামূলক কার্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, কোনো দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সংস্থারগুলোর পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ দেওয়া হয় সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করা উচিত। এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতার সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। যিনি দায়িত্ব পালনে দায়বদ্ধ তিনি দায়িত্বটি পালন করছেন কিনা সেটি দেখতে হবে। তিনি যদি ঠিকমতো দায়িত্ব পালন না করেন তবে অবশ্যই জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। বারবার কেন এত বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে তা অবশ্যই সবিস্তারে তদন্ত করে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেটকে ২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছিল। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন সময়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যদের নিয়েও ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে বঙ্গবাজারের নিরাপত্তা বিষয়ে করণীয় নিয়ে সভাও হয়। এ সময় তাদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ খান যুগান্তরকে বলেন, আমি যখন ফায়ারে ছিলাম তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা দাখিল করেছি। কোনো চিঠিতেই কাজ হয়নি। ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে এভাবে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটত না। তিনি বলেন, আমি চিঠি এবং প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দিইনি। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্নিনির্বাপক ঝুঁকি নিয়ে চিঠি দিয়েছি। এতে অনেকেই আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। আমি ফায়ার সার্ভিস থেকে চলে আসার পর তারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে।
৫ মার্চ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকার শিরিন ম্যানশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ৭ মার্চ গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজারে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ভবনের বেজমেন্ট থেকে এই বিস্ফোরণের সূত্রপাত উল্লেখ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বলেন, বেজমেন্টে এক সময় তিতাস গ্যাসের সংযোগ ছিল। পরে এটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, সংযোগটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় বিচ্ছিন্ন করা হয়নি। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ থেকে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এর আগে ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর ঢাকার মগবাজারের ওয়্যাললেস গেট এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তদন্ত বেরিয়ে আসে, সেখানে আগে তিতাস গ্যাসের সংযোগ ছিল। যা যথযথভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষের সচেতনতার পাশাপাশি তিতাস, ওয়াসা, রাজউক এবং সিটি করপোরেশ অধিকতর তৎপর হলে অগ্নিদুর্ঘটনা এবং বিস্ফোরণের ঘটনা কমানো সম্ভব।