পাঁচ শতাংশ করে গত দুই মাসে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। মোটকথা তিন দফায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, ‘এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে টিকে থাকা দায়। তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে আরও চাপ বাড়ানো হলো। আয় বাড়লো না, বাড়লো ব্যয়। এত চাপ নিয়ে কি টিকে থাকা যায়?’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দু’মাসে ১৫ ভাগ বলা হলেও বাস্তবে তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। সরকার যে ভর্তুকির কথা বলে দাম বাড়াচ্ছে, বাস্তবে তা ধোপে টেকে না। কারণ, এখন জ্বালানি তেল আর গ্যাসে ভর্তুকি দিতে হয় না। বিদ্যুতে কত ভর্তুকি দিতে হয়, তা স্পষ্ট নয়। আর ভর্তুকি দিতে হলেও বিদ্যুৎ খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচের কারণে হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘এভাবে বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রফিট মার্জিন কমে যাচ্ছে। আমরা বার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ার কথা বলায় ক্রেতারা বিব্রত হচ্ছেন। গত দু’বছরে ২১৭টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ফলে আরো ছোট ছোট পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। শ্রমিকরা চাকরি হারাবে। মূল্যস্ফীতিও আরো বাড়বে। ফলে আমাদের ওপর তারা বেশি বেতনের চাপ দেবে।’
তার ভাষ্য, ‘অন্য শিল্প কারখানাও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় একই পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা দাম বাড়ানোর পরো আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।’
গত ১২ ও ৩০ জানুয়ারি শতকরা পাঁচ ভাগ করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। আর ২৮ ফেব্রুয়ারি আবারো পাঁচ ভাগ বাড়নো হয়, যা ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়।
বিদ্যুতের নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে কম ব্যবহারকারী শ্রেণিতে প্রতি ইউনিটের দাম চার টাকা ১৪ পয়সা থেকে বেড়ে হয়েছে চার টাকা ৩৫ পয়সা। এটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য, যাদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ৫০ ইউনিট, যারা একটি বা দু’টি লাইট ও ফ্যান ব্যবহার করেন তাদের জন্য। পরের ধাপে চার টাকা ৬২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে চার টাকা ৮৫ পয়সা। আর আবাসিক খাতে সর্বোচ্চ ব্যবহারকারী গ্রাহকের ক্ষেত্রে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩ টাকা ২৬ পয়সা। কৃষিকাজের সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম চার টাকা ৫৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে চার টাকা ৮২ পয়সা।
সরকার চলতি বছর থেকে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কমাতে প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় শুরু করেছে। আর ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছি। বিদ্যুতের দাম বাড়ায় এটা আরো বাড়বে। ফলে সব কিছুর দাম আরো এক ধাপ বেড়ে যাবে। যার চাপ বহন করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের।’ তিনি আরো বলেন, ‘এর ফলে কৃষি, শিল্পসহ সব উৎপাদন খাতে খরচ বেড়ে যাবে।’
এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সরকার বলছে তারা ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়াচ্ছে। এর সাথে আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ। কিন্তু আমার বিবেচনায় বিদ্যুৎ খাতে অপচয়, অব্যবস্থাপনা দূর করলে দাম বাড়াতে হতো না। আসলে দুর্নীতি ও পরিকল্পনাহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।’
সরকার দাবি করছে যে চলতি অর্থবছরেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিতে হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকার বলছে, এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬-১৭ টাকা খরচ হচ্ছে। আর সরকারের পরিকল্পনা হলো বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি তুলে দেয়া।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সামসুল আলম বলেন, ‘আসলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সাথে অসম ও অযৌক্তিক চুক্তি করা হয়েছে। আদানি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। রামপাল ও পায়রায় একই কাজ করা হয়েছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দেরি হচ্ছে, তাই আমাদের উল্টো রাশিয়াকে জরিমানা দিতে হচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব? আর ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে অর্থ অপচয় তো আছেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আসলে পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলা হচ্ছে। আমরা শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের আমদানি নির্ভর হয়ে যাই কিনা সেটাই দেখার বিষয়।’