রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরের ৪৭ রোডের ২৫ নম্বর আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এমন তথ্য ভিত্তিতে অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি)। অভিযান চলাকালে ভবনটির ৪ তলায় থাকা একটি স্পা সেন্টারের দুই কর্মী পালিয়ে যাওয়ার জন্য লাফ দেন। এতে ফারজানা আক্তার (১৯) নামে এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে, আরেকজন গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
নিহত তরুণীর মৃত্যুর পর স্পা সেন্টারটি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কত জন নারী সেখানে কাজ করতেন আর স্পা সেন্টারটির মালিক কে তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় স্পা সেন্টারে কীভাবে দেহ ব্যবসা চলতো তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ৩-৪ চার বছর আগে হাসান নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ভবনটির চার তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সেই ফ্ল্যাটে তার স্ত্রী পায়েলকে দিয়ে স্পা সেন্টারটি পরিচালনা করে আসছিলেন হাসান। মূলত সেখানে স্পা সেন্টারের আড়ালে চলতো দেহ ব্যবসা। আগে একাধিক বার হাসানের স্পা সেন্টারটিতে অভিযান পরিচালনা করেও সেটি বন্ধ করা যায়নি। এছাড়া হাসানের চলাফেরা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকায় তাকে এ বিষয়ে ভয়ে কিছু বলতে পারতেন না ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের মালিকরা।
অভিযানের শুরু থেকে শেষ
প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিযান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বুধবার দুপুর ২টার দিকে ডিএনসিসির একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এপিবিএনসহ ডিএনসিসির একটি দল ৬ তলা ভবনটিতে প্রবেশ করে। আবাসিক ভবনের নামে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে— এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ভবনটিতে অভিযান পরিচালনা করে ডিএনসিসি। অভিযানের একপর্যায়ে ভবনের চার তলার স্পা সেন্টারে প্রবেশ করে আভিযানিক দল।
এদিকে অভিযানের কথা শুনে স্পা সেন্টারে কর্মরত নারীরা পালানোর জন্য বিভিন্ন রাস্তা খুঁজতে থাকেন। এসময় ফারজানা ও তার দুই নারী সহকর্মী অভিযানকারী দল থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখতে ভবনের বাম পাশের একটি কক্ষের এসির কম্প্রেসারের ফাঁক দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এসময় ফারজানা ও তার আরেক সহকর্মী এসি কম্প্রেসারের ফাঁক দিয়ে পাশাপাশি থাকা দুটি ভবনের নিচের ফাঁকা জায়গায় পড়ে যান। তাদের তৃতীয় সহকর্মী এসির কম্প্রেসারের ফাঁকে আটকে থাকেন। পরে তাকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে জীবিত উদ্ধার করেন। অন্যদিকে ফারজানা নিচে পড়ে যাওয়ায় তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, এ কারণে তিনি হাসপাতালে মারা যান।
ঘটনার সময় উপস্থিত থাকা একজন প্রত্যক্ষদর্শী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আভিযানিক দলটি ভবনে প্রবেশ করার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে উপর থেকে নিচে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে আমরা দৌড়ে যাই। আমরা ভবনের বাম পাশের নিচের খালি জায়গায় গিয়ে দেখি, পাশাপাশি দুই ভবনের মাঝে দুই নারী পড়ে আছেন। এদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল, অন্যজন গুরুতর আহত হয়ে কাতরাচ্ছিল। তখন কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের ধরাধরি করে নিয়ে আসে। এর প্রায় ৩০ মিনিট পর থানা পুলিশ এলে ওই দুই নারীকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে স্পা সেন্টার থেকে ৮-১০ জন নারীকে গাড়িতে তুলে নিয়েও যায় অভিযানকারী দলটি।
স্পা সেন্টারের আড়ালে চলতো দেহ ব্যবসা
ভবনটির বিভিন্ন অফিসে কর্মরতরা ও গার্ডরা জানান, ইশরাত নামে এক নারী ক্রয় সূত্রে ৪ তলার স্পা সেন্টারটির ফ্ল্যাটের মালিক। তিনি ৩-৪ বছর আগে হাসানকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেন। ভাড়া নেওয়ার পর হাসান তার স্ত্রী পায়েলকে দিয়ে এখানে স্পা সেন্টারের ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত স্পা সেন্টারের কার্যক্রম চলতো।
তারা আরও জানান, স্পা সেন্টারটিতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন উঠতি বয়সী নারীর আসা যাওয়া ছিল। মূলত তাদের দিয়েই হাসান ও পায়েল স্পা সেন্টারের নামে দেহ ব্যবসা করাতেন।
এ বিষয়ে ভবনটির এক তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৩-৪ বছর ধরে পায়েল এখানে স্পা সেন্টারের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনা করে আসছিল। প্রতিদিন মেয়েরা এখানে আসত। এছাড়া প্রতিদিন নানা বয়সের পুরুষরা স্পা সেন্টারটিতে যেতেন। এই কার্যক্রম চলতো দুপুর থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এ বিষয়ে ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের মালিকরা অভিযোগ করলেও কারো কথাই শুনতেন না হাসান।
স্পা সেন্টার নিয়ে কথা বললেই হুমকি দিতেন হাসান
ভবনটিতে প্রতিদিন অফিসে করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্পা সেন্টারের মালিক হাসান প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্পা সেন্টারের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে— এ কথা জানার পর অন্য ফ্ল্যাটের মালিকরা বিভিন্নভাবে হাসানকে বলেন এটি বন্ধ করে দিতে। ভবনটিতে কয়েকজন সংসদ সদস্যেরও ব্যক্তিগত অফিস ছিল। কিন্তু হাসান কারো কথা শুনতেন না, উল্টো যারা বন্ধ করার কথা বলতেন তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিতেন। এছাড়া হাসানের লোকজন ভবনটির আশপাশে সবসময় ঘোরাঘুরি করতেন। তাদের ভয়ে লোকজন কিছু বলতে পারত না।
ভবনটিতে অফিস করতে আসা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৬ তলা ভবনের প্রতি তলায় চারটি করে ইউনিট। প্রতিটি ইউনিটে বিভিন্ন অফিস রয়েছে। এর মধ্যে ৪ তলার একটি ইউনিটে হাসান তার স্ত্রীকে দিয়ে স্পা সেন্টারটি পরিচালনা করত। একসময় যখন অন্য ফ্ল্যাটের মালিক ও অফিসের লোকজন জানতে পারে স্পা সেন্টারের আড়ালে হাসান দেহ ব্যবসা করছে তখন সবাই বাধা দেয়। কিন্তু হাসান উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে সবাইকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। যেহেতু ফ্ল্যাটের মালিকরা অফিস ভাড়া দিয়েছেন আর তারা এখানে থাকেনও না, সেহেতু অফিস করতে যারা আসা-যাওয়া করতেন তারা হাসানের ভয়ে কোনো কথা বলতেন না।
হাসানের স্পা সেন্টারে আগেও দুই বার অভিযান হয়েছিল
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভবনে একজন কেয়ারটেকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্পা সেন্টারটিতে আগেও দুই বার পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে ৭-৮ জন মেয়েকে আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসান ২-৩ দিন পরই তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসত, আবার কার্যক্রম শুরু করত। তার এমন ক্ষমতা দেখে কেউই ভয়ে কিছু বলার সাহস পেত না। হাসানের এমন উৎপাতের কারণে অনেক ফ্ল্যাট মালিকই ভবনটিতে আসতেন না। এছাড়া কয়েকজন সংসদ সদস্যও ভবনটিতে অফিস করেন। তবুও কেউই হাসানকে থামাতে পারেনি।
বুধবার (১১ জানুয়ারি) রাজধানীর গুলশানে একটি স্পা সেন্টারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অভিযানের সময় ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে এক তরুণী মারা যান এবং আরেক তরুণী গুরুতর আহত হন। নিহত তরুণীর নাম ফারজানা আর আহত তরুণীর পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মূলত অভিযানটি ছিল ফুটপাত দখলমুক্ত করা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স খতিয়ে দেখার। এর সঙ্গে বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিনা অনুমতিতে কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা দেখতেই অভিযানটি পরিচালিত হচ্ছিল। অভিযানের সময় ওই ভবনের গেটে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আভিযানিক দলটি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ভবনের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমন সময় হঠাৎ ছাদ থেকে দুজন তরুণী পড়ে যান। তাৎক্ষণিক বিষয়টি দেখতে পেরে ওই দুই তরুণীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে ওই স্পা সেন্টারে অভিযান আর পরিচালনা করেননি ম্যাজিস্ট্রেট।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন জানান, স্বাচ্ছন্দ্যে জনগণের চলাচল নিশ্চিত করতে ফুটপাত দখলমুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স খতিয়ে দেখা, আবাসিক এলাকায় বিনা অনুমতিতে কোনো ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না তা দেখতেই অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল।
জানা গেছে, ছাদ থেকে পড়ার পর গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের দুজনকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। কর্তব্যরত চিকিৎসক ফারজানাকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত অন্যজনকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহত ফারজানার বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটা এলাকায়।
ফারজানার স্বামী জাহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বাসা খিলক্ষেত এলাকায়। গুলশানে একটি বিউটি পার্লারে কাজ করে আমার স্ত্রী। সেখানে মোবাইল কোর্টের অভিযান চলছে শুনে ভয় পেয়ে সে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে সর্বশেষ আইনি কার্যক্রম নিয়ে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ শাহিনুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযানে আটক সাত জন কর্মীকে আমাদের থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করছে, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।