দধি-চিড়ার দাম নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে একটি মিষ্টির দোকান ভাঙচুর করেছে বরিশালের ডিসি মার্কেটের (হাজী মুহম্মদ মহসিন হকার্স মার্কেট) ব্যবসায়ীরা। এসময় পুলিশসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে বরিশাল নগরীর লঞ্চঘাট বিআইডব্লিউটিসি ভবনের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আজ বেলা ১১টার দিকে লঞ্চঘাট এলাকার ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারে দধি-চিড়া খেতে যান পার্শ্ববর্তী ডিসি মার্কেটের পোশাক ব্যবসায়ী সৌরভ ঢালী। সোমবার (৯ জানুয়ারি) একই পরিমানের দধি-চিড়া খেলে ৩০ টাকা দাম রাখলেও আজ মঙ্গলবার ওই পরিমাণের খাবার খেলে ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার ভবতোষ ঘোষ ভানু ৪০ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে দুই ব্যবসায়ীর মধ্যে প্রথমে বাগবিতণ্ডা, পরে তা হাতাহাতিতে রূপ নেয়।
এ বিষয়ে সৌরভ ঢালী বলেন, দরদাম নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ভবতোষ ঘোষ ভানু আমার গায়ে হাত তোলেন। এমনকি তার কর্মচারীও আমাকে মারধর করেন। পরে আমি পুরো বিষয়টি আমার মার্কেটের (ডিসি মার্কেট) ব্যবসায়ীদের জানাই। তারা আমাকে মারধর করার কারণ জানতে চাইলে তাদের ওপরও হামলা চালানো হয়।
মিলন নামে সড়কের ভাসমান এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবতোষ ঘোষ ও সৌরভ ঢালীর মধ্যকার মারামারি এখানকার লোকজন থামিয়ে দেয়। কিন্তু সৌরভ ঢালী মহসিন মার্কেটে গিয়ে কী বলেছে জানি না, পরক্ষণেই দেখি পুরো লঞ্চঘাট সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে এসে ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারে ভাঙচুর চালায় এবং ওই দোকানের কর্মচারীদের মারধর করেন।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাস্থলে পুলিশ বাধা দিলে পুলিশের ওপরও হামলা করতে দেখা যায়। এতে দুইজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। দুই ব্যবসায়ীর মারামারির ঘটনা কে যেন সাম্প্রদায়িক উস্কানি হিসেবে ছড়িয়ে দেয়। এরপর সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয়। তিনি বলেন, দধি-চিড়ার দাম নিয়ে মারামারির ঘটনা ‘মুসলমানকে মেরে দাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে হিন্দু দোকানী’ হিসেবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন গুজব ছড়ানোর পর আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি পুলিশ।
ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত জামাল উদ্দিন ও হেলাল নামে দুইজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহসিন মার্কেটের ব্যবসায়ীকে মারধরের প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলাম। এসে দেখি পুলিশ আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। আর মারধরকারী ভবতোষ ঘোষ ভানুকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেছে। আমাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে প্রথমে লঞ্চঘাট, পরে থানা ঘেরাও করে বিচারের দাবি জানাই।
এই দুইজন আরও বলেন, থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিচারের আশ্বাস দিলে আমরা ঘেরাও কর্মসূচি স্থগিত করেছি। তাদের দাবি, পুলিশের মারধরে ৫ জন আহত হয়েছেন।
ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের অভিযুক্ত ম্যানেজার ভবতোষ ঘোষ ভানু দাবি করেছেন, দধি-চিড়ার দাম ৪০ টাকা, তা আমাদের দোকানের মূল্য তালিকায় লেখা রয়েছে। কিন্তু ওই ছেলে (সৌরভ ঢালী) মিথ্যা বলে ১০ টাকা কম দিতে চেয়েছিল। এ নিয়ে ঝামেলা হয় এবং বিষয়টি সেখানেই সমাধান হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শত শত মানুষ এসে দোকানে ভাঙচুর চালায় এবং আমাকে মারধর করে।
এ বিষয়ে ডিসি মার্কেট (হাজী মুহম্মদ মহসিন হকার্স মার্কেট) ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আকেনুর, সাধারণ সম্পাদক শেখর দাস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (অপারেশন) বিপ্লব কুমার মিস্ত্রি ঢাকা পোস্টকে বলেন, লঞ্চঘাটের ঘটনায় আহত সৌরভ ঢালীর পিতা বাদী হয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার ভবতোষ ঘোষ ভানু এবং কর্মচারী শ্যামলকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।
মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ফজলুল করিম জানান, ১০ টাকা দরদাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মারামারি দিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। বিক্ষুব্ধরা ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের মিষ্টির দোকান ভাঙচুর করেছে। এছাড়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) শিহাব এবং সেলিম সরদার আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
সাম্প্রদায়িক উস্কানির চেষ্টা
এদিকে দুইজন ব্যবসায়ীর মধ্যে মারামারির ঘটনা একটি পক্ষ সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এতে মুহূর্তেই এই মারামারির ঘটনা ‘টক অব দ্য টাউন’-এ পরিণত হয়। বিভিন্ন স্থানে গুজব ছড়িয়ে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মুসলমানদের মারধর করে দাড়ি ছিঁড়ে ফেলেছে। এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর পরিস্থিতি হঠাৎ জটিল আকার ধারণ করে। মহসিন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা ছাড়াও চারপাশের এলাকা থেকে কয়েক’শ মানুষ এসে পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে ফেলে। এমনকি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার ভবতোষ ঘোষ ভানুকে আটক করে পুলিশের ভ্যানে করে থানায় নিতে চাইলে সেখানে বাধা দেওয়া হয়। বিক্ষুব্ধরা নিজ হাতে বিচার করার জন্য ভ্যান থেকে ভবতোষ ঘোষ ভানুকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, লঞ্চঘাট এলাকার পরিস্থিতি পুরোপুরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সেখানে কতিপয় ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। উস্কানিদাতাদের শনাক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে।