মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম। ছায়া সরকারে ভূমিকা পালনের জন্য প্রতি পাঁচ বছর পর গঠন করা হয় সংসদীয় কমিটিগুলো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সাবেক মন্ত্রী ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রধান করে এসব কমিটি গঠন হয়। প্রতিমাসে একটি বা দুই-তিন মাসে একটি নিয়ম রক্ষার বৈঠক এবং কিছু সুপারিশ ছাড়া তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।
রোববার জাতীয় সংসদ ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। কমিটির সভাপতি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এতে সভাপতিত্ব করেন। কমিটির সদস্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. আব্দুস শহীদ, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী, আহমেদ ফিরোজ কবির, রুমানা আলী, রানা মোহাম্মদ সোহেল, মো. হারুনুর রশিদ এবং বিশেষ আমন্ত্রণে ফখরুল ইমাম এতে উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকটই দেশের বড় এবং অন্যতম সমস্যা। রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, খাদ্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত গুরুত্বপূর্ণ এই খাত। কিন্তু চলমান অর্থনৈতিক সংকট এবং এ থেকে উত্তরণ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি ওই বৈঠকে। দশ সদস্যের কমিটির কেউ এ নিয়ে আলোচনা উত্থাপন করেননি।
কমিটি সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২২ নামে একটি বিল আর আগের বৈঠকের কার্যবিবরণী অনুমোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বৈঠকের যাবতীয় আলোচনা। পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস্ বিল- ২০২২ নিয়ে আলোচনার কথা থাকলে পরবর্তী বৈঠকে আলোচনার জন্য তা স্থানান্তরিত হয়। এর বাইরে তেমন কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এর আগের বৈঠকেও দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমরা মূলত বিলটি নিয়েই আলোচনা করেছি। কারণ এই বিলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রচলন করা হচ্ছে দেশে এই প্রথম। তাই এটি ভালোভাবে পর্যালোচনার জন্যই বৈঠকে কথা হয়েছে। আরও একটি বিল নিয়ে আলোচনার কথা ছিল। সময়স্বল্পতার কারণে আলোচনা করতে পারিনি। একই কারণে অন্যান্য বিষয় নিয়েও আলোচনা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেই এ রকম ঘটনা ঘটেনি। এ রকম ঘটনা অন্যান্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও ঘটছে। মূল কাজকে পাশ কাটিয়ে অধিকাংশ কমিটি অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এর সঙ্গে আছে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আগ্রহ প্রকাশ।
সংসদ সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, কৃষি, খাদ্য, নৌপরিবহণ, পানিসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, মহিলা ও শিশু, মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিশ্রুতিসহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়।
নিয়ম রক্ষার এসব বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সমস্যা কিংবা দেশের সমস্যা- কোনো বিষয় আলোচনার টেবিলে প্রাধান্য পায়নি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমেই বড় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। এর সঙ্গে নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে সীমান্তে গোলাগুলির বিষয়টি। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। একই ঘটনা ঘটেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও। চলমান বিদ্যুৎ সংকট এবং এ থেকে উত্তরণ নিয়ে কথা হয়নি। একই চিত্র বেশির ভাগ সংসদীয় কমিটির বেলায়।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন রোববার যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় কমিটির কাজ মন্ত্রণালয়ের কাজের খবরাখবর নেওয়া। কোথাও কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি পাওয়া গেলে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া। কোনো বিষয়ে সুপারিশ করার থাকলে তা করা। এর বাইরে আসলে কিছু করার নেই। আর সংসদীয় কমিটির হাতে তেমন কোনো ক্ষমতাও নেই-এটাই বাস্তবতা।
তিনি বলেন, আমরা একেবারেই যে সমস্যা নিয়ে কথা বলি না বা আমাদের বৈঠকে সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় না-এমন তথ্য বা দাবি সঠিক নয়। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে যতটুকু কাজ করার করি, করছিও।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার রোববার যুগান্তরকে বলেন, সংসদ যেমন অকার্যকর। তেমনি সংসদীয় কমিটিগুলোও অকার্যকর। তিনি আরও বলেন, মূলত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোকে বলা হয় ছায়া মন্ত্রিসভা বা ছায়া সরকার। মন্ত্রণালয় তার কাজকর্ম সঠিকভাবে করছে কিনা-এটা দেখার দায়িত্ব সংসদীয় কমিটির। কিন্তু তারা তা করছে না। তারা ব্যস্ত তদবির বাণিজ্যে, নিজেদের আখের গোছানোর কাজে আর বিদেশ ভ্রমণে। মূল কাজটি তারা করছেন না। এটাও রাষ্ট্রের অর্থের এক ধরনের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।