মাদারীপুর ও কালকিনিতে আড়িয়াল খাঁ নদ নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। ভাঙন বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে নদীপাড়ের লোকজন।
সরেজমিনে জানা যায়, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে চর কালকিনি ও চরহোগলপাতিয়া গ্রাম। এ গ্রামের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ। গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত হয়ে রয়েছে। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। নদীভাঙনে চলে গেছে এ গ্রামের অনেক বাড়িঘর, কয়েকশ একর ফসলি জমি ও চরহোগলপাতিয়া হাওলাদার বাড়ির জামে মসজিদ।
স্থানীয়রা জানায়, আড়িয়াল খাঁ নদী ভাঙতে ভাঙতে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আর সরে যাওয়ারও জায়গা নেই। বৃষ্টির মৌসুম এলেই গরু-বাছুর, গাছপালাসহ মূল্যবান সম্পদ নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। দুই গ্রামের মানুষ ও তাদের জানমাল রক্ষার জন্য স্থায়ী বাঁধের দাবি জানিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে।
ভাঙন কবলিতদের অভিযোগ, বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নদীর ভাঙনরোধে কোনো কাজ শুরুই হয়নি এখনো। তবে মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে সারা জেলায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরেজমিনে ভাঙন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আগেই রুদ্ররূপ ধারণ করেছে আড়িয়াল খাঁ নদ। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার চরকালকিনি এলাকা থেকে হোগলপাতিয়া পর্যন্ত সাড়ে ১৮ কিলোমিটার নদ তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। গত এক মাসে সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের এক শতাধিক বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এবং তিন একর জমির ওপর কলাবাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার ভাঙনকবলিতরা সহায়-সম্বল হারিয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙে কেউ রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারের নারী-শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ভাঙনে নিঃস্ব মানুষরা।
হোগলপাতিয়া গ্রামের জলিল বেপারী বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদ ভাঙনে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি হারিয়েছি। আটবার ঘর সরিয়ে অন্য জায়গায় বসত গড়েছি। আবার ভাঙলে আর যাওয়ার কোনো জায়গা থাকবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা মকসেদ আকনের বয়স ৯০ বছরের মতো। কৌতুহলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো নদী কম ভাঙে। আমরা যখন জোয়ান ছিলাম, তখন নিমিষেই ভেঙে ঘরবাড়ি বিলীন হতে দেখেছি। আমি প্রায় ৮০ বারের বেশি দেখছি নদীভাঙন। চোখের সামনেই অনেকের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেছি। ফসলি জমি বাড়ি-ঘর হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। এখন যারা এই এলাকায় বসবাস করছেন, তাদের অনেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খুব ঝুঁকির মুখে আছি। আমার আশপাশে থাকা ১০টি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। গত বছর আমার চাচাতো ভাই টিটল আকনের ঘর এক রাতের মধ্যে নদীতে চলে গেছে। এখন আমি ভয়ের মধ্যে আছি, কখন জানি আমার ঘর নদীতে টান দেয়। এর আগে আমার একটি কলার বাগান ছিল। তাও নিয়ে গেছে। বউ পোলাপাইন লইয়া কই যামু, কী খামু আর কই থাকুম? আমাগো মরা ছাড়া আর গতি নাই। সরকার যদি একটা পাকা বান্ধের (বেড়িবাঁধ) ব্যবস্থা করতেন, তাইলে অন্তত ভরসা পাইতাম।’
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে লাল মিয়া হাওলাদার বলেন, তিনবার এই নদীতে বাড়ি নিয়ে গেছে। এখন আমি রাস্তার পাশে একটি বাড়ি করে পোলাপান নিয়ে থাকি। সরকার যদি আমাদের একটু নদীভাঙন রোধ করে, তাহলে আমরা ঠিকমতো থাকতে পারব।
ঝাউদি ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার লোকমান বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের অবশ্যই সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
আলীনগর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সাহিদ পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙন রোধের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। শিগগিরই সেখানে জিওব্যাগ ফেলানো হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
জানতে চাইলে মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এ বি এম মাহবুবুল আলম খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে এলাকায় ভাঙন বেশি, তার একটি তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই সেখানে জিওব্যাগ দেওয়া হবে। আমরা স্থায়ীভাবে নদীভাঙন রোধে সারা জেলায় দেড় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পটির সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষার প্রতিবেদন হাতে আসলেই আমরা বাঁধের কাজ সম্পন্ন করব।