দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল দিন তিনেক আগে। তিনি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আক্ষেপ করে বললেন, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে তারা পড়েছেন এক বিব্রতকর অবস্থায়। যে অবস্থার কথা বলাও যাচ্ছে না; আবার সহ্য করাও যাচ্ছে না।
২০১৮ সালে সাকিবকে শুভেচ্ছাদূত করেছিল দুদক। শিশু, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ সাকিবকে আদর্শ মানেন। সাকিবের কথায় দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হবে এমন ভাবনায় তাকে দিয়ে দুর্নীতিবিরোধী কয়েকটি বিজ্ঞাপনও বানিয়েছে সংস্থাটি।
সেইসব বিজ্ঞাপনে সাকিব দেশের মানুষকে বলেছেন, দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে। সৎ পথে চলতে। সাকিবের এমন মধুর বচনই যেন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে দুর্নীতি দমনকারী সংস্থাকে।
নিজেদের শুভেচ্ছাদূতের বিরুদ্ধেই উঠছে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে তাকে দূত হিসেবে রাখাও বিব্রতকর আবার তাকে শুভেচ্ছাদূত থেকে বাদ দেওয়াও ঠিক হবে না বলে দুদকের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন।
ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপচারিতার পরদিন দুদকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে পেরেছি। সংস্থাটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজ্ঞাপন কিংবা দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণামূলক কাজে সাকিব আর ব্যবহার করবে না সংস্থাটি।
পাশাপাশি সাকিবের আগের ভিডিও বিজ্ঞাপনগুলোও আর ব্যবহার করবে না। এটা সংস্থার লিখিত কোনো সিদ্ধান্ত নয়; নীতিগত সিদ্ধান্ত। এর ফলে কাগজে কলমে শুভেচ্ছাদূত থাকলেও বাস্তবে আর দুদকের দূত হিসেবে দেখা যাবে না আলোচিত এই ক্রিকেটারকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সাকিব আল হাসানকে নিয়ে কেন এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানকে। যে প্রতিষ্ঠানের দূত হয়ে তিনি বলেছেন, অনিয়ম-দুর্নীতিকে না বলতে সেখানে উল্টো নিজেদের দূতের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। যেন ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে’ অবস্থা!
সাকিব দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত। কিন্তু দুদকের শুভেচ্ছাদূত হওয়া আর অন্য প্রতিষ্ঠানের দূত হওয়া এক বিষয় নয়।
যে সাকিবকে দেশের মানুষ অনুসরণ করে, কারো কারো কাছে তিনি আদর্শ, তাকে কেন বিতর্কিত পথে হাঁটতে হবে। সাকিব কেন জুয়া বা বেটিংভিত্তিক নিউজ পোর্টালের সাথে চুক্তি করতে করবে? যা আবার ২ আগস্ট ২০২২-এ তার ফেসবুক পেজেই ঢালাও করে প্রকাশ করেছেন।
২০১৮ সালে সাকিবকে শুভেচ্ছাদূত করেছিল দুদক। নিজেদের শুভেচ্ছা দূতের বিরুদ্ধেই উঠছে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী জুয়া কিংবা জুয়া সংক্রান্ত যেকোনো চুক্তি অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, সাকিবের সঙ্গে চুক্তিকৃত ওয়েবসাইট বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ব্লক করা আছে অনেক আগে থেকেই।
১৮৬৭ সালের আইন অনুযায়ী এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকি সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদেও নৈতিকতা রক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্র জুয়া নিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে বলে বলা হয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী সাকিব ফেঁসে যেতেই পারেন ফৌজদারি আদালতে। যদিও শেষ পর্যন্ত সাকিব বেটিংভিত্তিক নিউজ পোর্টাল বেট উইনারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন।
বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডের শেয়ার কারসাজির সঙ্গেও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সাকিবের শেয়ার কারসাজির বিষয়টি। যদিও আমি মনে করি এটা প্রমাণিত নয় কিন্তু অভিযোগগুলো তো সুনির্দিষ্ট।
খেলার দুনিয়ার বাইরে ব্যবসা বাণিজ্যেও সাকিব যেভাবে জড়িয়েছেন তা অবাক করার মতো। এসব আর্থিক কর্মকাণ্ডের কোনো কোনোটিতে জড়িয়েছেন বিতর্কিত উপায়ে।
অবসরে যাওয়ার আগেই নানা আর্থিক কর্মকাণ্ডে বড় পরিসরে জড়িয়ে গেছেন সাকিব? প্রশ্ন উঠতে পারে তার কি অর্থবিত্তর অভাব? কৌতূহলবশত সাকিবের সম্পদের পরিমাণ কত তার জন্য কয়েকটি ওয়েবসাইটে সময় ব্যয় করলাম।
সাকিবের মোট সম্পদের পরিমাণ কত তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই তবে খেলোয়াড়দের আয় ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে এমন কিছু পোর্টাল থেকে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে সাকিব আল হাসানের সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ কোটি ডলার [ক্রিকট্রেকার, CricTracker)]। অন্যদিকে নেটওর্থআইডিয়া (Net Worth Idea) বলছে, ২০২১ সালে সাকিবের সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা।
খেলার দুনিয়ার বাইরে ব্যবসা বাণিজ্যেও সাকিব যেভাবে জড়িয়েছেন তা অবাক করার মতো। এসব আর্থিক কর্মকাণ্ডের কোনো কোনোটিতে জড়িয়েছেন বিতর্কিত উপায়ে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া বেতন, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে আয়, পণ্যের দূত হিসেবে আয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসা থেকে আয়ের ভিত্তিতে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের পরিমাণ হিসাব করেছে ওয়েবসাইটগুলো। এই সোর্সগুলো নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও ধারণা করা যায়, সাকিব বৈধ পথেই বেশ সম্পদশালী।
সাকিব আল হাসানের আসলে কত টাকা প্রয়োজন? দেশি-বিদেশি ম্যাচ খেলে, বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য বৈধ আয়েই সাকিব যে অর্থ উপার্জন করেন তা অনেকে অবৈধ পথে হেঁটেও উপার্জন করতে পারে না।
সাকিব আল হাসানের ভক্তরাও জানেন, সাকিব আর বিতর্ক যেন এক সুতোয় গাঁথা। শুধু আর্থিককাণ্ড নয়; নানা কারণে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার। কখনো খেলার মাঠে সতীর্থদের সঙ্গে বাজে আচরণ করে, কখনোবা দর্শক-মিডিয়া কিংবা বোর্ডের নিয়ম ভঙ্গ করে।
মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে সাকিবের এমন আচরণে বরাবরই সমালোচনা হয়েছে। সাকিব নিজেকে শুধরে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে সেটি দেখা যায়নি।
সাকিব বাংলাদেশ জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট দলের অধিনায়ক। তার হাতে লাল সবুজের পতাকা। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের নেতৃত্ব তিনিই দিচ্ছেন। দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে সাকিব নিজেকে শুধরে উঠবেন। নানা বিতর্কের পরও দেশের মানুষ সাকিব আল হাসানকে ভালোবাসে।
সাকিবের বিকল্প সাকিব’ই। যে কেবল নিজেকেই ছাড়িয়ে যেতে পারে। খেলার দুনিয়ায় বাংলাদেশের জন্য যে সম্মান বয়ে এনেছেন এই অলরাউন্ডার তা এখনো পর্যন্ত আর কেউ পারেনি। সাকিব শুধরে উঠে শুদ্ধতার পথে হাঁটার চেষ্টা করবেন এমন প্রত্যাশাই করে ক্রিকেট প্রিয় বাঙালির।