নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের পক্ষে ও বিপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইভিএমের পক্ষের ১৭ দলের যে তালিকা ইসি প্রকাশ করেছে, তা দেখে তালিকার বেশ কয়েকটি দল বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ইসি বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানিয়েছে।
কমিশন গত বুধবার প্রকাশ করা তার কর্মপরিকল্পনায় বলেছে, সংলাপে অংশ নেওয়া ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছে।
যেসব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনী সংলাপে অংশ নিয়েছিল, তাদের প্রস্তাব ও মতামতের ভিত্তিতে এই তালিকা করা হয়েছে।
ইসির সঙ্গে সংলাপ করেনি বিএনপিসহ ৯টি নিবন্ধিত দল। ইসির কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, সংলাপে অংশ নেওয়া ১৭টি দল ইভিএমের পক্ষে ও ১২টি দল বিপক্ষে মত দিয়েছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় ইভিএম ব্যবহার না করা যুক্তিসংগত হবে না বলে মনে করে কমিশন। কমিশন উভয় পক্ষের মতামতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে অনূর্ধ্ব ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যুক্তিসংগত মনে করছে।
গত ৩১ জুলাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালও বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না। অনেককেই আস্থায় আনতে পারছে না। ’
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ গত শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ইভিএমের পক্ষ-বিপক্ষ দলের তালিকা নিয়ে প্রশ্নের বিষয়টি কমিশনের নজরে এসেছে। সংলাপে অডিও শুনে কমিশন এ তালিকা প্রস্তুত করেছে। এর পরও এতে কোনো ভুল আছে কি না, তা রবিবার (আজ) কমিশন খতিয়ে দেখবে।
দলগুলো যা বলছে : কমিশনের তালিকায় ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে থাকা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আমরা ইভিএমের পক্ষে সরাসরি কোনো মত প্রকাশ করিনি। আমরা বলেছি, সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করলে তার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। ’
বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব এম এ মতিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সংলাপে আমরা লিখিতভাবে ৯ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এতে স্পষ্টভাবে নির্বাচনে ইভিএম না ব্যবহার করার জন্য বলা হয়েছে। তা ছাড়া মৌখিকভাবেও আমরা ইভিএমের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছি। সাংবাদিকদেরও আমাদের প্রস্তাব সম্পর্কে জানিয়েছি। এর পরও নির্বাচন কমিশন কেন আমাদের ইভিএমের পক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করল, তা বুঝতে পারছি না। এটা দুঃখজনক। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ নয়, আমরা নির্বাচন কমিশনের গতিবিধি, কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণে রাখতে চাই। ’
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ‘আমরা ইভিএম বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, এর ব্যবহার স্বচ্ছ হতে হবে। এতে যেন কারচুপি না হয়। এর মানে এই নয় যে আমরা ইভিএমের পক্ষে বলেছি। ’
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সংগঠন প্রধান আবু লায়েস মুন্না বলেন, ‘আমরা সেভাবে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিইনি। বলেছি, যদি ইভিএম ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে মেট্রোপলিটন এলাকায় এটি ব্যবহারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ’
জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, ইভিএম ব্যবহার করতে হলে ৩০০ আসনেই ব্যবহার করতে হবে। ১৫০ আসনে ইভিএম আর ১৫০ আসনে ব্যালটে ভোট নিলে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া বলেছি, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটারদের অভ্যস্ত করতে হবে এবং এই মেশিন সম্পর্কে ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ’
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী বলেন, ‘আমরা আমাদের লিখিত প্রস্তাবে বলেছি, দেশের সহজ-সরল মানুষ ইভিএম বোঝে না। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেরই এ মেশিন সম্পর্কে ধারণা নেই। ইভিএম ব্যবহার না করে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এই বক্তব্যের লিখিত কপি সাংবাদিকদেরও দিয়েছি। ’
ইভিএমের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেওয়া দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের সই করা প্রস্তাবেও বলা হয়, ‘ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণে বাস্তব কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। কিছু প্রশ্ন এবং বিতর্কও তৈরি হয়েছে। জাসদ ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে চিহ্নিত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে ইভিএম পদ্ধতিকে কারিগরিভাবে ত্রুটিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য করার পাশাপাশি ব্যালট পদ্ধতিতেও ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার আহবান জানাচ্ছে। ’
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের আরেক শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গত ২৫ জুলাইয়ের সংলাপে কমিশনের কাছে লিখিত প্রস্তাবে বলেছে, ইভিএম পদ্ধতি সম্পর্কে যেসব ত্রুটি, অপূর্ণতা ও ভোগান্তি হয়েছে তাতে ইভিএম সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টি মনে করে, ত্রুটি, অপূর্ণতাগুলো সমাধান করলে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক দূর হবে। আর রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। কোনো কিছু চাপিয়ে দিয়ে নয়।