প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। কেউ কেউ শ্রীলঙ্কা বানাচ্ছে বাংলাদেশকে। একটা কথা মনে রাখবেন, বাংলাদেশ কোনো দিন শ্রীলঙ্কা হবে না, হতে পারে না। ’ শেখ হাসিনা গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এই আলোচনাসভার আয়োজন করে।
দেশবাসীর উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি শুধু বলব, অপচয় রোধ করতে হবে, সব কিছুর ব্যবহার সীমিত করতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে, সাশ্রয়ী হতে হবে। কারণ এই যুদ্ধ আমেরিকার নির্বাচনের আগ পর্যন্ত থামবে না। এটা হলো বাস্তবতা এবং এতে পৃথিবী আরো ভয়াবহ অবস্থায় পড়বে। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আপনারা দেখেছেন, সারা পৃথিবীতে কিছু লোক আছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা রকম অপকর্ম করে যাচ্ছে। এরা কারা? যারা এই দেশে বিভিন্ন অপরাধ করে দেশ থেকে ভেগেছে, হয় যুদ্ধাপরাধী, যাদের বিচার আমরা করেছি, তাদেরই ছেলেপেলে, ১৫ই আগস্টের খুনি, যাদের আমরা বিচার করেছি, তাদেরই আপনজন, আর কিছু অপরাধী, যারা এখান থেকে অপরাধ করে পালিয়ে যায়। নানা ধরনের অপপ্রচার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে করে বেড়াচ্ছে। ’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমি অনেক কথা শুনি। আমি এখন সরকারে আছি। মানবাধিকারের কথা শোনায় আমাদের। মানবাধিকার নিয়ে আমাদের তত্ত্বজ্ঞান দেয়। কিন্তু আমার কাছে যখন এই কথা বলে বা দোষারোপ করে, তারা কি একবারও ভেবে দেখে যে আমাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল যখন আমরা আপনজন হারিয়েছি? স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে কেঁদে বেড়িয়েছি। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে জীবন্ত মানুষকে হত্যা করে, তাদের মুখ থেকে মানবতার কথা শুনতে হয়। তাদের মুখে আমরা মানবতার কথা শুনি। মানবাধিকারের কথা শুনি। ২০১৩-১৪ ও ২০১৫ সালে একটার পর একটা ঘটনা তারা ঘটাতে চেষ্টা করেছে। তারা এখনো করে যাচ্ছে। ’ আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী। বক্তব্য দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কচি প্রমুখ।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার দাবির প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আহ্লাদের আর শেষ নাই। পৃথিবীতে কোন দেশে আছে, এতিমের অর্থ আত্মসাৎকারী, সাজাপ্রাপ্ত আসামি জেলে ছিল না? অন্তত আমি এইটুকু দয়া করেছি যে বয়োবৃদ্ধ মানুষ, বয়স্ক লোক, হাঁটতে-চলতে, উঠতে-বসতে অসুবিধা, শুইলে একজন না ধরলে উঠতে পারে না। জেলখানায় যখন এই অবস্থায় দেখেছি, বলেছি, ঠিক আছে, যেহেতু আমার ক্ষমতা আছে, সেই এক্সিকিউটিভ পাওয়ার আছে, তার মাধ্যমে আমি তার বাসায় থাকার সুযোগটা করে দিয়েছি। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে (খালেদা জিয়া) আমাকে খুন করতে চেয়েছে, আমার বাবা-মা-ভাইদের হত্যার সঙ্গে জড়িত; তার জন্য যথেষ্ট দয়া দেখানো হয়েছে। যে আমার হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে, নির্যাতন করেছে; তার জন্য এর বেশি দয়া দেখানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আসামিকে কে কবে বিদেশে পাঠায় চিকিৎসার জন্য? তাহলে তো কারাগারের কোনো আসামি আর বাদ থাকেবে না, সবাই দাবি করবে, আমাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠান। আমরা কি সবাইকে পাঠাব?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অনেক দুঃখে কথাগুলো বললাম। অনেক অপপ্রচার হচ্ছে, দেশে-বিদেশে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আমাদের নেতাকর্মীদের তার উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। আমরা সংঘাত চাই না। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেটা দেখিয়ে গেছেন। ’
প্রতিবেশী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় পাচার হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় চোরাচালান বন্ধ হয়েছে, এতে দেশের সাশ্রয় হয়েছে। এখন প্রতি লিটারে জ্বালানি তেলের দাম পাঁচ টাকা করে কমানো হয়েছে। ’ বৈশ্বিক সংকটের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যেখান থেকে গম বা সার কিনি, সেখানে এমন একটা অবস্থা…। যদিও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি, কিনতে পারব। তার পরও দেশের মানুষ যেন কষ্ট না পায়, সে জন্য করোনার সময় বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছিলাম। ’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার গ্যাস উৎপাদন বাড়াচ্ছে। গ্যাস কিন্তু একটা কূপে চিরস্থায়ী নয়। তার পরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর জন্য বিদ্যুৎ কিছুটা সাশ্রয় করে যাচ্ছি। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ যেন কষ্ট না পায়, যে হঠাৎ করে (বিদ্যুৎ চলে) যাবে; সেটা করা হচ্ছে সাশ্রয় করার জন্য। আমরা যদি এখন থেকে সাশ্রয়ী না হই, তাহলে আগামী দিনে যে বিশ্বমন্দা হবে, তাতে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হব। সেদিকে লক্ষ রেখে পদক্ষেপ নিয়েছি। ’
সব বিষয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক ফোঁটা পানি যেন অতিরিক্ত ব্যবহার করা না হয়। নিয়মিত পানির ট্যাংক পরিষ্কার করতে হয়। পাইপলাইনগুলো ঠিক আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। দেশের অনেক জায়গায় পাইপলাইন পরিবর্তন করেছি। ’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগুন লাগলে পানি পাওয়া যায় না। আগুন লাগলে সুইমিংপুল থেকে পানি আনতে হয়। সেটা যেন না হয়। প্রতিটি এলাকার খাল, পুকুর সংরক্ষণ করতে হবে। ’
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের ভয়াবহ বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় বাংলাদেশ ত্রাণ পাঠাবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আর্তমানবতার সেবায় আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় উদার। এরই মধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি সেখানে বন্যায় কী লাগবে, সেখানে বাচ্চারা খুব কষ্টে আছে। তাদের জন্য খাবার এবং কী কী দেওয়া যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা এরই মধ্যে করতে বলেছি। আমরা তাদের ত্রাণ পাঠাব। ’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা যুদ্ধে (১৯৭১ সালে) জয়ী হয়েছি। সেই হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। আমরা সেটাই পালন করছি। জাতির পিতা আমাদের তা শিখিয়েছেন। আমরা আর্তমানবতার সেবায় তাদের পাশে আছি। ’
অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মাঝখানে হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চের সামনের দিকে বসে থাকা শেখ ফজলে শামস পরশকে মঞ্চে ডাকতে বলেন। এ সময় মঞ্চে থাকা শেখ পরশের ছোট ভাই এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এগিয়ে গিয়ে শেখ পরশকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় দুজনে কোলাকুলি করেন। এরপর দুজনেই প্রধানমন্ত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। দুজনকে পাশে রেখেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য চালিয়ে যান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর-দক্ষিণ আয়োজিত স্মরণ সভায় ১৫ আগস্টে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্মরণে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন।