তান্ত্রিকের অভিশাপে অভিশপ্ত ১০০ বছরের পুরনো এই প্রাসাদ

প্রাচীন ভারতের ঐশ্বর্য বার বার বহিরাগত শত্রুর বিস্ময় ও লোভের কারণ হয়েছে। রাজতন্ত্রের অবসান হলেও এই দেশে এখনও এমন কিছু পরিবার আছে, যাদের রীতিনীতি রূপকথার রাজ পরিবারের মতোই। খাতাকলমের ক্ষমতা চলে গেলেও তাদের জীবনযাত্রা রাজকীয়। সেই ধারার অন্যতম উদাহরণ যোধপুরের রাজ পরিবার। অতীতে যোধপুর স্টেট ছিল মারওয়াড় প্রদেশের অংশ।

ইতিহাস বলছে, অষ্টম শতকে এই রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাঠৌরদের হাতে। এখনও অবধি রাঠৌর-রাই যোধপুর রাজবংশের ধারক ও বাহক। ১২২৬ থেকে ১৮১৮ অবধি যোধপুর ছিল মারওয়াড় প্রদেশের অধীন। ১৮১৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই রাজন্য স্টেট ছিল ব্রিটিশ শাসনের অধীন। বর্তমানে এই পরিবারের প্রধান হলেন মহারাজা গজ সিংহ দ্বিতীয়। রাজতন্ত্র মুছে গেলেও ‘মহারাজা’ উপাধি এখনও তার নামের সামনে অলঙ্কার। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে তিনি এই উপাধির অধিকারী। মহারাজা গজ সিংহ, তার স্ত্রী মহারানি হেমলতা রাজে, তাদের ছেলে যুবরাজ শিবরাজ সিংহ, তার স্ত্রী আসকটের রাজকুমারি গায়ত্রীকুমারী এবং তাদের দুই সন্তান বর্তমানে থাকেন উম্মেদ ভবনে। মহারাজা গজরাজ এবং রাজমাতা হেমলতার একমাত্র মেয়ের নাম শিবরঞ্জনী রাজে।

যোধপুরের অন্যতম আকর্ষণ উম্মেদ প্রাসাদের একটি অংশে পরিবার নিয়ে থাকেন মহারাজা গজ সিংহ দ্বিতীয়। বাকি অংশে আছে সংগ্রহশালা। এ ছাড়া বাকি অংশ এখন বিলাসবহুল হোটেল। রক্ষণাবেক্ষণ করে তাজ গ্রুপ। বিশ্বের বৃহত্তম ব্যক্তিগত বাসভবনের মধ্যে এই প্রাসাদ অন্যতম। বলা হয়, পৃথিবীতে এই একটি প্রাসাদই তৈরি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীতে। বাকি সব প্রাসাদ তার থেকে প্রাচীন। কথিত, ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে যোধপুর রাজবংশের তৎকালীন প্রধান রাও যোধাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এক তান্ত্রিক। প্রাসাদ নির্মাণের জন্য তান্ত্রিককে তার গুহা থেকে উৎখাত করতে উদ্যত হয়েছিলে রাজকর্মচারীরা। তান্ত্রিকের অভিশাপ ছিল, এই বংশের শাসন বার বার বিঘ্নিত হবে খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে।

কাকতালীয় বা সমাপতন যাই হোক না কেন, উম্মেদ ভবনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ক্ষরার সম্পর্ক। ১৯২৯ সালে এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেছিলেন বর্তমান রাজা দ্বিতীয় গজ সিংহের ঠাকুরদা উম্মেদ সিংহ। উদ্দেশ্য ছিল, খরা ও দুর্ভিক্ষে কর্মহীনদের কাজ ও খাবারের সংস্থান করা। ১৯৪৩ সালে এর নির্মাণপর্ব শেষ হয়। বিদেশি স্থপতির পরিচালনায় এই প্রাসাদ নির্মাণে তখনকার দিনে খরচ হয়েছিল এক কোটিরও বেশি অর্থ।

তবে নতুন প্রাসাদে পরিবারের বসবাস শুরু হওয়ার চার বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় মহারাজ উম্মেদ সিংহের। ২৬ একর জমির উপর বিস্তৃত এই প্রাসাদে রাজকীয় জীবনযাপনের সব উপকরণ মজুত। রাজ দরবার, বিশাল ভোজনকক্ষ, বলনাচের ঘর, পাঠাগার, একাধিক সুইমিং পুল, স্পা, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, টেনিস ও স্কোয়াশ খেলার কোর্ট-সহ বিলাসিতার অঢেল আয়োজন। প্রাসাদ তৈরির উপকরণ আনানোর জন্য আস্ত রেললাইনই বসিয়ে দিয়েছিলেন রাজ উম্মেদ সিংহ।

১৯২৯ সালের আগেও এখানে রাজপরিবারের অন্য বাসভবন ছিল। তবে শুধু কর্মসংস্থানের জন্য নতুন করে প্রাসাদ নির্মাণ শুরু হয়। তবে কেবলমাত্র ৩৪৭ কক্ষের উম্মেদ ভবনই নয়। যোধপুরের রাজ পরিবারের অধীনে আছে আরো রাজসিক বাসভবন। তাদের পরিবারের মেহরনগড় কেল্লাও বিশ্বের বৃহত্তম প্রাসাদের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও তাদের গাড়িশালে সাজানো থাকে একাধিক বহুমূল্য ভিন্টেজ কার। মহারাজ গজ সিংহের বহু কাজের মধ্যে অন্যতম রাজমাতা কৃষ্ণকুমারি গার্লস পাবলিক স্কুল প্রতিষ্ঠা। এখন দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই স্কুলটিকে ধরা হয়। রাজ্যসভার দীর্ঘদিনের সদস্য মহারাজ গজ সিংহ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর হাইকমিশনার পদেও ছিলেন।

যোধপুরের বর্তমান মহারাজা দ্বিতীয় গজ সিংহ রাজা হয়েছিলেন মাত্র চার বছর বয়সে। তার বাবা মহারাজা হনবন্ত সিংহ ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯, মাত্র দুই বছর। স্ত্রী রাজমাতা কৃষ্ণকুমারীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। কারণ এক স্কটিশ নার্সের প্রেমে পড়েছিলেন দক্ষ পোলো খেলোয়াড় হনবন্ত সিংহ। পরে সেই সম্পর্ক ভেঙে তিনি নতুন প্রেমে জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন বিখ্যাত অভিনেত্রী জুবেইদার সঙ্গে।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে জুবেইদাকে বিয়ে করেন মহারাজা হনবন্ত সিংহ। কিন্তু দুই বছর পরে এক বিমান দুর্ঘটনায় তাদের দুজনেরই মৃত্যু হয়। তার পরই মহারাজা উপাধি পান শিশু গজরাজ। বর্তমানে এই রাজপরিবারের উপার্জনের মূল উৎস হোটেল ব্যবসা। ব্যবসার দেখভাল করেন মহারাজা গজরাজ সিংহ এবং তার ছেলে যুবরাজ শিবরাজ সিংহ। যোধপুরের বাল সমন্দ লেক প্যালেস, মাউন্ট আবুর মহারানি বাগ গার্ডেন রিট্রিট-এর মালিকানাও তাদের। এই প্রাসাদগুলোও ব্যবহৃত হয় বিলাসবহুল হোটেল হিসেবেই।