সমুদ্রের ৪০০ ফুট গভীরে সারি সারি মরদেহ, থমকে গেলেন ডুবুরিরাও

পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি ‘ডাইভিং সাইট’-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’। মধ্য আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলের বেলিজ সিটি এলাকায় এই পর্যটনস্থলটি স্কুবা ডাইভারদের প্রিয় জায়গা। আয়নার মতো স্বচ্ছ পানির তলায় বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী, হাঙরের দেখা মেলে ইউনেস্কো স্বীকৃত এই এলাকায়।

১৯৭১ সালে সমুদ্রের মাঝে এই জায়গাটি প্রথম জ্যাকুয়েস কস্টিউ নামে এক ব্যক্তির নজরে আসে। সমুদ্রের গাঢ় নীল পানির মধ্যে প্রবাল-শৈবাল দিয়ে ঘেরা এই জায়গাটি দেখতে অনেকটা গর্তের মতো। দেখে মনে হয় যেন সমুদ্রের মাঝে থাকা একটি চোখ। সমুদ্রের মাঝে এর সন্ধান পাওয়ার পর ডুবুরিরা অজানা রহস্যের খোঁজে ব্লু হোলের গভীরে তল্লাশিতে নামে। তবে পানির গভীরে ডুব দিলেও একজন ডুবুরিও ফিরে আসেননি। ব্লু হোলের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া ডুবুরিরাও যেন এই রহস্যের অংশ হয়ে উঠেছিলেন।

সমুদ্রের মাঝে এর সন্ধান পাওয়ার পর ডুবুরিরা অজানা রহস্যের খোঁজে ব্লু হোলের গভীরে তল্লাশিতে নামে

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জ্যাকুয়েসের প্রপৌত্র ফ্যাবিয়েন কস্টিউ আবার এই অঞ্চলে অভিযান চালান। তার সঙ্গ দেন ধনকুবের রিচার্ড ব্রান্সন এবং এরিকা বার্জম্যান। তাদের তথ্যের উপর ভিত্তি করে গবেষকরা একটি ‘মিনি ডকুমেন্টারি’ তৈরি করেন। শুধু তাই নয়, তারা ব্লু হোলের একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করেন। এই তথ্যগুলো গবেষকদের কাছে এক নতুন আলোর দিশা তুলে ধরেছে।

বার্জম্যান এই প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ৪০০ ফুট গভীর এই গর্তে প্রবেশ করে তারা বুঝতে পারেন সেখানে অক্সিজেনের লেশমাত্র নেই। প্রায় ২৯০ ফুট গভীরে অক্সিজেনের পরিবর্তে পানির মধ্যে হাইড্রোজেন সালফাইডের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বার্জম্যান আরো জানান ২৯০ ফুটের পর থেকে পানির যত গভীরে যাওয়া গিয়েছে ততই অন্ধকার বেড়েছে। পচা ডিমের দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসটি পানির সঙ্গে এমনভাবে মিশে রয়েছে যা পানির তলায় একটি পুরু আস্তরণ তৈরি করেছে।

এই আস্তরণ ভেদ করে পানির তলায় যেতেই ডুবুরিরা দেখেন, পানির তলায় অসংখ্য গুহা। তবে বেশির ভাগ গুহার প্রবেশপথ বন্ধ। অবশেষে, ডুবুরির দল একটি গুহা খুঁজে পান যার মুখ খোলা। খুব সহজেই গুহার মুখ গলে ভেতরে গিয়েছিলেন বার্জম্যানরা। তবে গুহার ভেতর যা দেখলেন, তা দেখে রীতি মতো চমকে যান তারা। গুহাগুলো স্ট্যালাগটাইট পাথর দিয়ে তৈরি। চুনাপাথর ও অন্য খনিজের সঙ্গে গুহার ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া পানি মিশে কেলাস পদ্ধতিতে এই পাথর তৈরি হয়। তবে পানির তলায় যে গুহার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সেই গুহার ছাদ থেকে আবার পানি পড়বে কী করে?

গবেষণা করে জানা যায়, এই এলাকাটি এক সময় পানির উপরে ছিল। বহু বছর ধরে তৈরি হওয়া এই গুহার চারদিকে জলস্তর বেড়ে যাওয়ার কারণে সেগুলো পানির তলায় ডুবে যায়। পানির তলায় কিছু শাঁখ এবং ঝিনুকের খোঁজ মেলে যা সচরাচর দেখা যায় না। এই ধরনের অবাক করা দৃশ্যের সাক্ষী থাকার কৌতূহলেই তারা গুহার আরো ভেতরের দিকে যেতে থাকেন। তবে তারা যে টর্চগুলো নিয়ে নীচে নেমেছিলেন, তাতে ব্যাটারির চার্জ খুব বেশি ছিল না। সেই কারণেই অন্ধকারের মধ্যেও বুঝেশুনে টর্চ জ্বালাতে হচ্ছিল তাদের।

অন্ধকারে এগিয়ে যেতেই একটা ভারী জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা খান বার্জম্যান। টর্চ জ্বালাতেই যা দেখলেন, তা দেখে নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তারা। পানির তলায় রয়েছে মৃতদেহের সারি। যে ডুবুরিরা ব্লু হোলের গভীরে অভিযান চালাতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন এই মৃতদেহগুলো তাদেরই। এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখার পর তারা আর বেশিক্ষণ পানির তলায় থাকতে পারেননি। পানির উপরে উঠে আসতেই তাদের কাছ থেকে গবেষকরা তথ্য সংগ্রহ করেন। তাদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে ব্লু হোল সম্পর্ককে ঘিরে অনেক অজানা রহস্যের সমাধান হয়। বার্জম্যানের মতে, যে ডুবুরিরা এত বছর ধরে নিরুদ্দেশ ছিলেন, তাদের পরিবারের সদস্যরা অবশেষে তাদের সম্বন্ধে জানতে পারলেন। এটাই তার মনকে শান্তি দেয়।

সূত্র: আনন্দবাজার